![]() রাজনৈতিক সংকট কাটিয়ে স্বস্তি ফেরানোই বড় চ্যালেঞ্জ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() এমন পটভূমিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র হিসেবে শপথ নেয়ার জন্য বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সমর্থকদের প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নিয়ে রাস্তা বন্ধ করে দেয়ার ঘটনায় সরকারের সাথে বিএনপি সম্পর্কের আরও অবনতির চিত্র প্রকাশ পায়।এ সরকার কোনো বিপ্লবী সরকার নয়। এ সরকার গঠনের উদ্দেশ্য ছিল স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের অবসানের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং সেজন্য প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো সাধন করে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এসব কার্যক্রম সম্পন্ন করার জন্য সরকারপ্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০২৬-এর জুনকে সময়সীমা নির্ধারণ করেন। কিন্তু যেসব পুরনো ও নবগঠিত রাজনৈতিক দল আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক তাদের মধ্যে প্রধান দল বিএনপি দাবি করেছে দ্রুত নির্বাচন। জামায়াত ও নবগঠিত এনসিপির দাবি হচ্ছে, এতটা তাড়াতাড়ি না হলেও চলবে। সেনাপ্রধান সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত। নির্বাচন কমিশনও জানিয়েছে যে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে তারা প্রস্তুত। ড.মুহাম্মদ ইউনূস এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেননি। এসব পরস্পরবিরোধী মতামত থেকে এক ধরনের রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে আশঙ্কা করেন যে সংস্কারের অজুহাতে সরকার তার ক্ষমতা প্রলম্বিত করতে চাচ্ছে অথবা নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সরকার এ মুহূর্তে গদি ছাড়তে নারাজ। সবচেয়ে গোলমেলে অবস্থান হচ্ছে এনসিপির। তাদের মধ্যে নানা পরস্পরবিরোধী শক্তি সমবেত হয়েছে।তবে সাধারণভাবে তারা এবং জামায়াত সরকারকে নির্বাচনের আগে আরো সময় দিতে চায় অথবা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে চায়। এর একটি উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে একটু সময় নিয়ে ক্ষমতার ভিত্তি তৈরি করা। কিন্তু সম্ভবত বিএনপি সেই সময়টা এদের দিতে চাইছে না। জামায়াত আমির কিছুদিন আগে লন্ডন সফরে গিয়ে বিএনপির মূল নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে একটি বৈঠক করে এসে বলেছিলেন যে ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটা ভালোই হবে। সুতরাং দ্রুত নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান স্পষ্ট নয়। বামপন্থীরা অবশ্য মনে করেন, দেশে অনির্বাচিত সরকার দিয়ে না হবে কোনো মৌলিক সংস্কার, না আসবে কোনো স্থিতিশীলতা। তাদের প্রিয় স্লোগান হচ্ছে-এ মুহূর্তে দরকার নির্বাচিত সরকার। তাদের মতে, দিন যত যাবে অনির্বাচিত সরকার আধাখেঁচড়া সংস্কারের জালে ততই আটকা পড়ে যাবে। রাজনৈতিক ক্ষমতার ভিত্তি ছাড়া শুধু স্বতঃস্ফূর্ত তরুণদের আন্দোলনের ওপর নির্ভর করে সংস্কারসিদ্ধ রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করছে তারা যা প্রথম থেকেই ছিল একটি অলীক স্বপ্ন ও ঝুঁকিপূর্ণ। ঝুঁকিপূর্ণ এ কারণে যে তাদের মধ্যে মতাদর্শগত প্রচুর ভিন্নতা যেমন শুরু থেকেই ছিল তেমনই ছিল নানা উচ্চাভিলাষী স্বপ্ন ও অভিজ্ঞতার অভাব। রাজনীতিবিদদের মতে, তাদের কোনো ভোটের অভিজ্ঞতাও নেই।ড.মুহাম্মদ ইউনূস এখন সেই আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এর মধ্যেই সরকার বিদেশ থেকে সব পরামর্শক ডেকে এনে নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ক্ষমতা তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তাদের নানা ধরনের উল্টাপাল্টা বাণী নানা সমস্যার সৃষ্টি করেছে। আমরা সবাই জানি, রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে একাধিক খেলোয়াড় এ অঞ্চলে খেলছেন। তাদের প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। মিয়ানমার, ভারত, চীন সবাই চায় রাখাইন রাষ্ট্র যেন মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন না হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের ইচ্ছা কিছুটা মিয়ানমার জান্তার বিরুদ্ধে, কিছুটা আরাকানের সাধারণ জনগণের মানবিক সংকট সমাধানের জন্য তারা তৎপর, আবার আমেরিকা চায় চীনকে হটিয়ে দিতে এবং সেই অর্থে এদের ভূমিকা কিছুটা মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মির অনুকূলে। যদিও করিডোর নিয়ে এক্ষেত্রে জাতিসংঘের অফিশিয়াল কোনো ঘোষণা আজ পর্যন্ত আমরা পাইনি। এ রকম একটি জটিল অবস্থায় হঠাৎ কার স্বার্থে নিরাপত্তা উপদেষ্টা মানবিক করিডোরের পক্ষে কথা বললেন, কার স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপনের কথা বললেন, তা নিয়ে বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক মহলে এ মুহূর্তে এক ধরনের তোলপাড় শুরু হয়েছে। এর ফলে সরকার, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন উপদেষ্টা, সরকার বিরোধী ও সরকারপক্ষীয় রাজনৈতিক শক্তি সবার মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নানা অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের বচসা। আরো যে সংকট এ সরকার তৈরি করেছে তা হচ্ছে, বন্দরের মতো একটি স্ট্র্যাটেজিক খাতের ব্যবস্থাপনা এমন এক বৈশ্বিক কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার চুক্তি করেছে যার কিনা রেকর্ড রয়েছে মার্কিন নৌবাহিনীর সঙ্গে বিশেষ সহযোগিতার। ফলে স্বভাবতই আমেরিকার ঘনিষ্ঠ ঐতিহাসিক বন্ধু।ড.মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি নানা সন্দেহের তীর ছোড়া শুরু হয়েছে। এ ধরনের অস্বচ্ছ জবাবদিহিহীন চুক্তি করার ম্যান্ডেট স্বভাবতই এ সরকারের নেই। তাই এটি অবশ্যই একটি সন্দেহজনক ও অবিমৃষ্যকারী উদ্যোগ। এর জবাব ইউনূস সরকারকে অবশ্যই দিতে হবে। এ ধরনের ভুল পদক্ষেপের মাধ্যমে বর্তমান ইউনূস সরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে এক সংকটের মধ্যে পতিত হয়েছে। এ থেকে মুক্তির সম্ভাব্য পথ হচ্ছে, নিজেদের নিরপেক্ষতাকে নিশ্চিত করে দ্রুত একটি মুক্ত পরিবেশ তৈরি করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। যেখানে স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে এবং গণতান্ত্রিক স্পেস প্রকৃতই পুনরায় উন্মুক্ত হবে। অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যেন বিচারে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসী কোনো দল বা বিভিন্ন আমলে গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ক্ষমতায় পুনরায় ফিরে না আসে। তাই বর্তমানে একটি সুষ্ঠু,অবাধ,নিরপেক্ষ,অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই হওয়া উচিত বর্তমান সরকারের সব কাজের মূল বিবেচ্য বিষয়। সেই পথেই তারা নিজেরাও মুক্ত হতে পারবেন, দেশকেও সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক অবস্থার মধ্য দিয়ে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের হাত থেকে আপাতত রক্ষা করতে পারবেন। তবে সব পক্ষকে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে। বর্তমান সরকারকে সফল করতে হবে এবং তাকে সময় দিতে হবে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে তীব্র সংকট ও বিভ্রান্তি বিরাজ করছে, তা দ্রুত ও সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সহজে কাটিয়ে ওঠা কঠিন। দেশের স্বার্থে প্রয়োজন রাজনৈতিক দলের মধ্যে সুদৃঢ় সংলাপ, দ্রুত মৌলিক সংস্কার, এবং সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরার পথ তৈরি। সময় এখন আর ধৈর্যের নয়; সংকট নিরসন ও দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার জন্য দ্রুত বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ অপরিহার্য। আমাদের রাজনৈতিক সংকটের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। আমরা আর কোনো সংকটের মুখোমুখি হতে চাই না। আমাদের প্রত্যাশা, জুলাই ঐক্য অটুট থাকুক। রাজনীতিতে মতপার্থক্য ও মতবিরোধ থাকতেই পারে, সেটিই স্বাভাবিক। তবে তা যেন দ্বন্দ্ব-সংঘাতে রূপ না নেয়। গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে সাধারণ মানুষ দ্বিধাবিভক্তি দেখতে চায় না। তাই দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সব পক্ষ ও রাজনৈতিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে আমরা দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করি।এজন্য সরকার,দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এবং গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে আলোচনার পথ খোলা রাখতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |