![]() বিপ্লবী মহানায়ক ইমাম খোমেনি লও সালাম
এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া:
|
![]() ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯০২ সালে ইরানের খোমেইন প্রদেশে সৈয়দ রুহুল্লাহ মুসাভি খোমেনি'র ঘড়ে জন্মগ্রহণ করেন রুহুল্লাহ খোমেনি। তার পিতা তৎকালিন ইরানের অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শাহাদাৎ বরন করেন। এতিম রুহুল্লাহ খোমেনি তার কঠোর পরিশ্রমের মাধ্য দিয়ে নিজেকে এবং সমাজকে বদলে ফেলেন। বিস্ময়কর তার জীবন। অনেকেই বলেন ইসলামী বিপ্লবের জন্যই তার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু, আমি মনে করি শুধু ইসলাম নয় সাম্রজ্যবাদী, আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মজলুমের মুক্তি লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিতেই তার জন্ম হয়েছিল। মাত্র সাত বছর বয়সে কোরআনের হাফেজ হন ইমাম খোমেনি। পরবর্তী কয়েক বছর গণিত শিক্ষা করেন। সহপাঠীদের পড়া বুঝতে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে এই মেধাবী মানুষটি শিক্ষকতায় প্রবেশ করেন। এ ছাড়াও খেলাখুলা, সাঁতার, দৌড়, ঘোড়ায় চড়া, এমনকি অস্ত্র পরিচালনায়ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী এবং অত্যন্ত দক্ষ হয়ে ছিলেন তিনি। সে সময় ইরান শাসন করত ব্রিটেন ও সোভিয়েত রাশিয়া। রুশ বাহিনী আক্রমণ করলে আত্মরক্ষার জন্য ১২ বছর বয়সী কিশোর খোমেনি তার বড় ভাইয়ের সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নিয়েছিলেন। ১৫ বছর বয়সে তার মা মারা যান। ইতিমধ্যেই তিনি আরবি সাহিত্য অধ্যয়নসহ বড় ভাই আয়াতুল্লাহ পসন্দিদাহের কাছে যুক্তিবিদ্যা, আরবি ব্যাকরণ শেখেন। এরপর ১৭ বছর বয়সে আরাকে গমন করে শেখ মুহাম্মদ গোলপায়গানির কাছে উচ্চতর যুক্তিবিদ্যা ও আব্বাস আরাকির কাছে শরহে লুময়া নামক ফিকাহর বই অধ্যয়ন করেন। প্রথমে ইরানের আরাক শহরে (১৯২০-১৯২১) এবং পরবর্তীতে কোমেতে (১৯২৩) ধর্মীয় শিক্ষা লাভ করেন। ১৯৩০-এর দশকে ইমাম খোমেনি কোমের ধর্মতত্ত্ব ছাত্রদের ইসলামী আইনশাস্ত্র শিক্ষা দেন। ১৯৫০-এর দশকে তিনি ইসলামী ফিকাহশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য অর্জন করে মুজতাহিদ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। ১৯৬১ সালে ইমাম খোমেনির রাজনৈতিক জীবন শুরু। ১৯৬৩ সালে তিনি তৎকালীন শাহ সরকারের অত্যাচার, নিপীড়ন ও আমেরিকা তোষণ নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সে সময় মুহাম্মদ রেজা শাহ ইরানে কথিত স্বেতবিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। ইমাম খোমেনির নেতৃত্বে দেশে বসবাসরত ইরানি জনগণের পাশাপাশি সারা বিশ্বে অবস্থানরত ইরানিরা শাহ সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সে বিপ্লব চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করে এবং এর মাধ্যমে আধুনিক বিশ্ব-ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেন ইমাম খোমেনি। ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার ১০ বছর অতিবাহিত করার পর ১৯৮৯ সালের ২৩ মে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হলে ইমাম খোমেনিকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর ১১ দিন পর ৪ জুন তিনি ৮৭ বছর বয়সে তেহরানের একটি হাসপাতালে ইন্তেকার করেন এই মহান নেতা। ইতিহাসের এক মহানায়কের অন্তিম যাত্রার মধ্য দিয়ে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে। আমার একজন প্রিয় কবি আবদুল হাই শিকদারের ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, "রক্ত ও ঘৃণার মাঝে ইরান মুহ্যমান/ অথচ আকাশে তখনও নেই জিবরাইলের ডানা/ আসে না খোদার বার্তাবাহক শান্তির নব নবী/নবীরা আসে না তবুও খোমেইনে একদিন কাঁপে মাটি / নীল আসমানে কেঁপে ওঠে ঝড় মানুষের মুনাজাতে...গাছেরা দোলায় সবুজ পতাকা নুরের তাজাল্লীতে/ হাজেরার কোলে এ কোন শিশু এমন মোহন রূপ/ পিতা মুস্তফা শোনে সেই মুখে শাহাদাৎ উথলায়/ এতো শিশু নয় হাজেরার কোলে নতুন ইসমাইল/ যেন বনি ইসরাইলের মধ্যে এলেন মুসা ... মুহূর্তে গনগন করে দেশ-রাহবর ওই এলো/ টগবগ করে ফুটে ওঠে দেশ-রাহবার ওই এলো/ শত যন্ত্রণা ফুল হয়ে ফোটে –রাহবার ওই এলো... ইমাম তুমি তাকালে সামনে জালিমের জিন্দান/ভেঙ্গে খান খান নমরুদ, আর ফেরাউন ভূপাতিত/ইমাম তুমি দু'হাত বাড়ালে ওমনি ফুটলো গোলাপ/বারুদে বারুদে জাগালে দারুণ জীবনের অঙ্কুর/ ইনসানিয়াত তোমার গর্বে পৃথিবীর পথে পথে/ ফেরি করে আজ নতুন শরাব স্বপ্নের কলরব/ সাম্য শান্তি মৈত্রীর বরাভয়/...ইমাম তোমার আলখেল্লায় আবেহায়াতের ছায়া / দু'চোখে তোমার মুহাম্মদের প্রেম/যুদ্ধ ও প্রেমে মহিমান্বিত আলীর জুলফিকার/আলবুর্জের শিখরের চেয়েও মস্তক যার উঁচু ... ইমাম তোমার কণ্ঠে আমার মুহাম্মাদের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কখনই আধিপত্যবাদীদের সাথে, সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে স্বাধীনতাকামী জনগণের আপোষ হয়নি। যুগে যুগে কোনো না কোনো জাতি বা জনগোষ্ঠী অন্যায়-অবিচার ও উপনিবেশবাদী বা সাম্রাজ্যবাদী এবং আধিপত্যকামী শক্তিগুলো ও তাদের স্থানীয় অনুচর কিংবা তাদের স্বার্থ রক্ষাকারী শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। তেমনি এক ঐতিহাসিক বিপ্লব হলো ইরানের ইসলামী বিপ্লব। বিংশ শতাব্দীর ইরানের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানের ইসলামী বিপ্লব, যার মাধ্যমে আমেরিকা-ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের অনুচর পাহলভী রাজবংশের পতন ঘটিয়ে ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সূচনা করা হয়। ইরানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। শুধু ইরানের বললে ভুল হবে বরং এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বিশ্বজুড়ে। ১৯৬১ সাল থেকে শুরু হয় ইমাম খোমেনীর আপোষহীন সংগ্রামের বিরামহীন অধ্যায়। ১৯৬৩ সালের শ্বৈত বিপ্লবের সময় বিভিন্ন সংস্কারের বিরুদ্ধে মোল্লা শ্রেণী আয়াতুল্লাহ খোমেনী ও আয়াতুল্লাহ তেলেখানী এর নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এ সময় শাহ খোমেনীকে বন্দি করেন। ফলে তেহরানে এক গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। শাহ সাময়িক পরিস্থিতি আয়ত্বে এনে খোমেনীকে দেশ থেকে বের করে দেন। দীর্ঘ ১৫ বছরের মতো ইরাকে নির্বাসন দেওয়া হয়। ফলে জনগণ আরো বেশি সোচ্চার হয়ে উঠে। বিদেশ থেকেও ইমাম খোমেনী মুহাম্মদ রেজা শাহ বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যান। ১৯৭৮ সালের ৭ জানুয়ারি এই আন্দোলন ভয়াবহ রুপ ধারণ করে। সেদিন এক সরকারপন্থী পত্রিকা ‘ইত্তিলিয়াত’ খোমেনিকে “বিদেশীদের মদদপুষ্ট বিশ্বাসঘাতক” বলে অভিহিত করে। আর তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে খোমেনির কিছু সংখ্যক অনুসারী রাস্তায় নামে। স্বৈরাচারী শাসক মুহাম্মদ রেজা শাহ চরম এক ভুল করে বসলেন। অল্প সংখ্যক মানুষই সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। সহজ কোনো উপায়ে তা দমন না করে তিনি কঠিন পন্থা অবলম্বন করলেন, সাধারণ মানুষগুলোর আন্দোলনে গুলি করে, লাঠিপেটা করে দমন করার চেষ্টা করলেন। যা পরবর্তীতে আরো প্রবল আকার ধারণ করলো। ৩/৪ সেপ্টেম্বর তারিখে বিক্ষুব্ধ জনতা এক শোভাযাত্রা করলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে খন্ডযুদ্ধ হয়। সরকার বিরোধী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ওই মাসেরই ৮ সেপ্টেম্বরে তেহরানের জালেহ স্কয়ারে জনসমাবেশ হয়। আগের রাতে তেহরানসহ আরো ১১টি শহরে জারি করা সামরিক আইন সম্পর্কে হয় এই জনসমাগম জানত না অথবা সামরিক আইনের প্রতিবাদে জড়ো হয়েছিল। জালেহ স্কয়ারে সেদিন হাজার হাজার লোকের সমাবেশ হয়। সমাবেশ ভঙ্গ করতে ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি শুরু করে। গুলিতে অসংখ্য লোক নিহত হয়। ফ্রান্সের মিশেল ফোকাল্টের হিসেবে ওইদিন কমপক্ষে ২ থেকে ৪ হাজার লোক নিহত হয়েছে কিন্তু বিবিসিসহ অন্যান্যরা দাবি করে করেছে ৮০ থেকে ১০০ জন লোক নিহত হয়েছেন ওইদিনে। এজন্য ইতিহাসের পাতায় এই দিনটা কুখ্যাত ব্ল্যাক ফ্রাইডে (Black Friday) বা কালো শুক্রবার নামে পরিচিত। তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের সিআইএ এজেন্ট ওয়াশিংটন ডিসিতে রিপোর্ট করেন যে, ৮ই সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর মুহাম্মদ রেজা শাহের শাসন ক্ষমতা এতোটাই সূদৃঢ় হয়েছে যে, আগামি ১০ বছরে বিরোধী পক্ষ মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না! এই হত্যাকান্ডের পর বিপ্লবী নেতা খোমেনী ঘোষণা দেন এই ৪০০০ জন নিরপরাধ প্রতিবাদীর মৃত্যুর পর আর কোন কিছু নিয়ে রেজা শাহের সাথে আলোচনা হতে পারেনা। হত্যাকান্ড ও তার পরবর্তি পরিস্থিতে স্বয়ং রেজা শাহ ঘাবড়ে যান এবং পরবর্তি কোন বিক্ষোভ দমন না করতে সিদ্ধান্ত নেন। ৯ সেপ্টেম্বর থেকেই সারাদেশব্যাপী শ্রমিকরা টানা কর্ম বিরতিতে অংশ নেয়। পরে পরিস্থিতি সামাল দিতে রেজা শাহ ইরাকের সরকারের সাথে আলোচনা করে খোমেনীকে ফ্রান্সের প্যারিসে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে জনগণ আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে ৪/৫ নভেম্বর সরকারী বাহিনীর সাথে এক মারাত্মক সংঘর্ষ সৃষ্টি হয়। খোমেনী ফ্রান্স থেকেই নির্দেশনা দিতে থাকেন। কিছুদিন পর নভেম্বরে ন্যাশনাল ফ্রন্টের করিম সানজাবি খোমেনীর সাথে ফ্রান্সে সাক্ষাত করে “ইসলামী গণতান্ত্রিক সরকার” গঠনে আপোষ করে। এদিকে ইরান জুড়ে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সহ বিক্ষুব্ধ জনতারা সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। পশ্চিমা আদর্শের সব স্থাপনা, চিহ্ন প্রভৃতি ভাংচুর করে। ব্রিটিশ ও আমেরিকা দূতাবাস সহ নানান জায়গা ভাংচুরসহ আগুনে পুড়িয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। পুলিশ, সেনাবাহিনী সঠিক নির্দেশনার অভাবে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি এবং মুহাম্মদ রেজা শাহও সাহস পায়নি কোনভাবে পরিস্থিতি দমন করার। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ৬ নভেম্বর রেজা শাহ সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন করে গুলাম রেজা আযহারীর নেতৃত্বে সামরিক সরকার গঠন করে এবং রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ইরানীদের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে ভাষণ দেয়। কিন্তু রেজা শাহের এই আবেগ ইরানীদের অন্তর স্পর্শ করতে পারে নাই। উপরন্তু খোমেনি ইরানীদের কোনরূপ আপোষ না করে সরকার পতনের আহবান জানায়। তার আহ্বানেই, সামরিক সরকারের রাস্তায় বিক্ষোভে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ২ ডিসেম্বর থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে আসে সরকার বিরোধীতায়। রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষুদ্ধ মুসলমানেরা নেমে আসলো। মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভীর পদত্যাগ ও খোমেনীর ইরানে প্রত্যাবর্তনের দাবীতে সারা দেশ জুড়ে বিক্ষোভ চলতেই থাকে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ৬০ থেকে ৯০ লক্ষ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে মুহাম্মদ রেজা শাহ করিম সানজানিসহ ১২০ জন বিরোধী দলীয় নেতাকে মুক্তি দেয়। কিন্তু ততক্ষনে পরিস্থিতি ক্রমশই হাতের নাগালের বাইরে চলে যায় মুহাম্মদ রেজা শাহের। ১১ ও ১২ ডিসেম্বর তারিখে জনগণ তিন আদর্শের সমন্বয়ে “আল্লাহ, ইরান ও খোমেনী” সবুজ বর্ণের পতাকা নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ শোভাযাত্রা করে। বিক্ষোভ শোভাযাত্রায় প্রায় ৫১ জন বিক্ষোভকারী নিহত হয়। ১১ ডিসেম্বরে ডজন খানেক সৈন্য নিহত হয় বিপ্লবীদের সাথে সংঘর্ষে। এমন অবস্থায় রেজা শাহ আমেরিকা-ব্রিটেনের সাথে দেন দরবার শুরু করে। কিন্তু আমেরিকা মুহাম্মদ রেজা শাহের পরিবর্তে খোমেনীকে সহায়তা না করলেও বাঁধা হয়ে দাড়ায়নি। পতন ঘটে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের। মুহাম্মদ রেজা শাহ সরকারের পতন ঘটলে ইরানের জনগণ উৎসবে মেতে ওঠেন। বখতিয়ার ইরানের ‘সাভাক’ বাহিনীকে বিলুপ্ত করে দেন এবং সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দেন। তিনি সব ধরণের বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিং করার অনুমতি দেন এবং বিপ্লবীদের একটি ঐক্যের সরকার গঠনের আহবান জানান। তিনি ইমাম খোমেনীকে দেশে ফেরার আহবান জানান। ১৯৭৯ সালের ১ লা ফেব্রুয়ারী আয়াতুল্লাহ খোমেনী ফ্রান্সের একটি চার্টার্ড বিমানে করে দেশে ফেরেন। তার দেশে প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে সেদিন কমপক্ষে ৭০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয়েছিল। দেশে ফিরে আয়াতুল্লাহ খোমেনী শুধুমাত্র ইসলামী বিপ্লবের একজন নেতা নন, তিনি ইরানের আধ্যাত্মিক নেতায় পরিণত হন। দেশে ফিরে তিনি বখতিয়ারের সরকারকে অস্বীকার করেন এবং জাতির চাওয়ার ভিত্তিতে নতুন সরকার গঠনের অঙ্গিকার করেন। ৫ ফেব্রুয়ারী খোমেনী মেহেদী বাজারগানের নেতৃত্বে একটি সরকার গঠন করেন এবং ইরানীদের সরকারের প্রতি আনুগত্য করার নির্দেশ দেন ধর্মীয় দায়িত্ব হিসেবে। খোমেনী সরকার গঠন করলে বখতিয়ারের সরকারের সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থার সুত্রপাত ঘটে। খোমেনি তার সরকারের সমর্থনে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহবান জানান এবং আমেরিকান এম্বাসিকে বখতিয়ারের প্রতি সমর্থন বন্ধ করার আহবান জানান। বখতিয়ার একেবারেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ৯ই ফেব্রুয়ারি খোমেনী-সমর্থক ‘দোশান তাপে এয়ার বেজে’ বিদ্রোহ করেন। তার সাথে ধীরে ধীরে অন্যান্যরাও যোগ দিতে শুরু করে। তারা অস্ত্রাগার লুট করেন এবং পুলিশ স্টেসন সহ নানা স্থাপনা দখল করা শুরু করেন। ১১ ফেব্রুয়ারিতে বখতিয়ারের সরকারের চুড়ান্ত পতন নিশ্চিত হয় যখন ইরানের সেনাবাহিনী নিজের পক্ষতাতিত্বহীন নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করে ঘোষণা দেয়। এরপরপরই খোমেনী সমর্থকরা সরকারি বিল্ডিং সহ নানা স্থাপনা দখল করে নেয় এবং রাজবংশের শাসনের সমা[প্তি নিশ্চিত করে। ১১ ফেব্রুয়ারী বখতিয়ার পদত্যাগ করে আত্মগোপন করেন। সমগ্র ইরান ইমাম খোমেনীর জয়ধ্বনিতে মেতে ওঠে। ১৯৭৯ সালের ১ এপ্রিল ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়। তবে ১১ ফেব্রুয়ারিকে ইরানের ইসলামী বিপ্লব বিজয় দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ইমাম খোমেনী ইরানের রাজনৈতিক ইতিহাসে যেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম যার নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল ইরানের ইসলামী বিপ্লব যা ছিল ইরানের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। এ আন্দোলন ছিল রেজা শাহের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ, কুখ্যাত সাভাক বাহিনীর নির্যাতন ও ইরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাবেদারী রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রাম। ইমাম খোমেনী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিগুলোকে জাগিয়ে তুলতে সকল সময় সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক যুগে ইসলামী ঐক্যের অন্যতম রূপকার। মুসলিম বিশ্বের প্রধান সংকট সমাধানের লক্ষ্যে তথা মুসলমানদের প্রথম কিবলা আল-আকসাকে পুনরুদ্ধারের জন্য তিনি প্রবর্তন করেন বিশ্ব-কুদস দিবস যা পালন করা হয় প্রতি বছর রমজানের শেষ শুক্রবারে। তাঁরই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে গড়ে উঠেছে ইসরাইল বিরোধী অদম্য বিজয়ী শক্তি লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ফিলিস্তিনের ইসলামী জিহাদ ও হামাস। ইহুদিবাদী ইসরাইলের মোকাবেলায় এইসব সংগ্রামী দলের গত কয়েক দশকের ও সাম্প্রতিক সাফল্য ইমাম খোমেনীর আদর্শিক অনুপ্রেরণার কাছে ঋণী । শহীদ সুলায়মানি তাঁরই আদর্শের অন্যতম ফসল। পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা)’র প্রতি অবমাননাকারী কুখ্যাত মুরতাদ সালমান রুশদির বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের ঐতিহাসিক ফতোয়া দিয়ে ইমাম খোমেনী (র) পাশ্চাত্যের সাংস্কৃতিক ক্রুসেডের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছিলেন। বিশ্বনবীর (সা) সুন্নত অনুসরণ করেই ইমাম তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ নেতা মিখাইল গর্বাচেভের কাছে ইসলামের দাওয়াত পাঠিয়েছিলেন এবং সমাজতন্ত্র জাদুঘরে স্থান পাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ইমামের ওই ভবিষ্যদ্বাণী কয়েক বছরের মধ্যেই সফল হয়েছিল। মার্কিন সরকারই যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শয়তান ইমাম খোমেনিই তা বিশ্ববাসীর কাছে সবার আগে তুলে ধরেছিলেন। এই শয়তানও যে অপরাজেয় নয় বরং তাগুতি শক্তি ও শয়তানের পতন যে অনিবার্য ইমাম খোমেনি সংগ্রামী মুসলমানদের মধ্যে এই ধারণাকে একনিষ্ঠ বিশ্বাসে পরিণত করতে চেয়েছিলেন যে বিশ্বাস বাস্তব হয়ে ওঠার পদধ্বনি এখন আরও স্পষ্ট। বিশ্ব-কাঁপানো ইসলামী বিপ্লবের মহানায়ক মরহুম ইমাম খোমেনীর মৃত্যু বার্ষিকীতে সবাইকে জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া: কলাম লেখক, রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক |