![]() সংকট মোকাবিলা করে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() এমনকি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও সরকারকে ছাড় দিচ্ছেন না। গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন এক ধরনের সমস্যা তৈরি হয়েছে, সেটি হচ্ছে 'মব'। এনিয়ে চলছে সমালোচনা। কিন্তু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না 'মব', ঘটছে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও। সব মিলিয়ে সরকার আবারও স্বৈরাচারী আমলের দিকে যাচ্ছে কি-না, সেই প্রশ্ন তুলছেন মানবাধিকারকর্মীরা। এসব দেখে মনে হচ্ছে দেশটা এক গোলক ধাঁধা মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্ত কেন? আমরা কি পারি না, সবাই একত্রিত হয়ে এসব ধাঁধা থেকে বেরিয়ে এসে একটি সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে।অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার তাগিদেই মানুষ একটি সংগঠিত কাঠামোর সন্ধান করেছে। সেখান থেকেই রাষ্ট্রের উদ্ভব। ইতিহাসের পরিক্রমায় একে একে আমরা দেখেছি রাজতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মতো শাসন ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা সীমাবদ্ধ ছিল একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে। রেনেসাঁর পর থমাস হবস, জ্যা-জ্যাঁক রুশো, জন লকের মতো দার্শনিকের চিন্তাধারা আধুনিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আটলান্টিক রেভল্যুশন থেকে ফরাসি বিপ্লব, রুশ বিপ্লব হয়ে লাতিন আমেরিকার বিপ্লবগুলো ছড়িয়ে দেয় স্বাধীনতার মশাল। গড়ে তোলে আধুনিক গণতন্ত্রের কাঠামো। বিশ শতকের বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে গণতন্ত্র সব অঞ্চলে শিকড় গাড়তে পারেনি। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলে পরিবর্তন ও কল্যাণ রাষ্ট্রের বাণী শুনিয়ে সামরিক বা ভিন্ন কৌশলে ক্ষমতা দখলকারী শাসকরা পরিণত হয়েছেন নতুন শোষকে। তাদের দমনপীড়নের ফলস্বরূপ একুশ শতকে আমরা বিশ্বজুড়ে দেখেছি রোজ বিপ্লব, অরেঞ্জ বিপ্লব, টিউলিপ বিপ্লব ও আরব বসন্ত, যার মধ্য দিয়ে ২০১১ সালে সরকারই পাল্টে যায়। এসব আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকদের পতন ঘটাতে প্রাথমিক ভাবে সফল হলেও, গণতন্ত্র ও স্থিতিশীলতায় তাদের সাফল্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতি আগের চেয়েও খারাপ হয়েছিল। ঠিক এমনই ঐতিহাসিক বিশ্ব-প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আমরা দেখি বাংলাদেশে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান। কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যে এভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটাবে, তা ছিল অভাবনীয়। এই অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পরিবর্তন নয়। এটি ছিল বৈষম্যহীন একটি সমাজ, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র এবং জুলুম-নিপীড়নমুক্ত বাংলাদেশের স্বপ্ন। প্রায় দুই হাজার শহীদের জীবন এবং ১৫ হাজার মানুষের আহতের বিনিময়ে অর্জিত এই পরিবর্তন সেই স্বপ্নকে কতটা বাস্তবায়ন করল? নয় মাস পেরিয়ে যখন আমরা সেই আত্মত্যাগ এবং স্বপ্ন বাস্তবতার নিক্তিতে মাপি, তখন গভীর হতাশা দেখা দেয়। হাজার হাজার আহত প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সুবিধা না পেয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। দুর্ভাগ্যজনক, শুধু রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। জনগণের মৌলিক আকাঙ্ক্ষাগুলো উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। বিপ্লবের মূল লক্ষ্য ছিল শুধু সরকার পরিবর্তন নয়; রাষ্ট্রের কাঠামো এবং বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ খাতে মৌলিক সংস্কার। কিন্তু নয় মাস পরও এসব সেক্টরে কাঙ্ক্ষিত ও কার্যকর সংস্কারের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোনো সংকটের পুনরাবৃত্তি।নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যের পরিবর্তে পারস্পরিক দোষারোপ, কাদা ছোড়াছুড়ি এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বই মুখ্য হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে যারা সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী ছিল, তাদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আজ আশঙ্কা হচ্ছে, বাংলাদেশের জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানও কি সেই পুরানো ব্যর্থতার পথে হাঁটছে? আমরা জানি, আরব বসন্তের ব্যর্থতার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে ছিল মূলত নেতৃত্বের অভাব; বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্যের ঘাটতি; শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতা; রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রভাব; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ; অর্থনৈতিক সংকট এবং চরমপন্থি গোষ্ঠীর উত্থান। বিভিন্ন গোষ্ঠী একত্র হয়ে শাসককে ক্ষমতাচ্যুত করলেও তারা ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গঠন বা শাসনভার পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। যেমনভাবে আরব বসন্তের আন্দোলনের বেশির ভাগই ছিল স্বতঃস্ফূর্ত এবং এর পেছনে কোনো একক বা শক্তিশালী সমন্বিত নেতৃত্ব ছিল না। তেমনিভাবে আমাদের গণঅভ্যুত্থানের পেছনে একক কোনো শক্তির ভূমিকা ছিল না। ধর্মনিরপেক্ষ,ইসলামপন্থি,তরুণ আন্দোলনকারী, আদিবাসী একত্র হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের পর এর কৃতিত্ব নেওয়াকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে নানা বিতর্ক এবং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য। যদি বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো জনগণের আকাঙ্ক্ষা ভুলে সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, আইনসহ মৌলিক সেক্টরগুলোর সংস্কার উপেক্ষিত হয়, তবে জুলাই বিপ্লবের ব্যর্থতা হয়তো অনিবার্য। রক্ত দিয়ে লেখা যে গণঅভ্যুত্থান এসেছে, সেটা যদি শুধু ক্ষমতার পট পরিবর্তনের দলিল হয়ে থাকে; জনগণের মুক্তির সনদ না হয়, তবে তা হবে শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি। ঝরে যাওয়া রক্তকে সম্মান জানিয়ে, আত্মত্যাগকারীদের স্বপ্নকে পাথেয় করে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে অবশ্যই জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সুস্থ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহি মূলক রাজনীতির পথে ফিরতে হবে। অন্যথায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে এবং আমাদের গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থতার করুণ অধ্যায় হিসেবেই লিপিবদ্ধ হবে। গণঅভ্যুত্থানের পর যেসব প্রত্যাশা পূরণে মানুষ অর্ন্তবর্তী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল, সেগুলোর সব যে পূরণ করা সম্ভব হয়নি উপদেষ্টারাও সেটি স্বীকার করছেন। এমন একটা গণঅভ্যুত্থানের পর মানুষের প্রত্যাশা বেশি ছিল। তবে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার কারণে সবকিছু অ্যাড্রেস করা সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা আছে এবং সেটা থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু নয় মাসেও প্রত্যাশা পূরণ করা যায়নি কেন?এমন প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যারা গণঅভ্যুত্থান করেছে, তারা ফ্যাসিবাদের বিভিন্ন উপাদান, যেমন: রাষ্ট্রপতি, সংবিধান ইত্যাদি, আর দেখতে চায়নি। কিন্তু এসব ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর এক ধরনের জনবিরোধী অবস্থান ও অসহযোগিতার পরিস্থিতি এবং মতৈক্য না হওয়ার কারণে অনেকগুলো বিষয় ঝুলে গেছে। অন্যদিকে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও মতপ্রকাশের ওপর আঘাতের ঘটনায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারকেই দুষছে সরকার। শেখ হাসিনার সময় দীর্ঘ ১৬ বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, সেই জায়গা থেকে সেগুলো পুনরায় দাঁড় করাতে হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যেভাবে মোরাল অবলিগেশনে ফেলে দেওয়া হয়েছে, ফলে তারা এখন মাঠে প্রকৃতঅর্থে দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এটাকে অনেকে সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে এবং বিভিন্ন জায়গায় হামলা ও বাকস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে।তবে সরকার এগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এমনকি এসব বিষয়গুলোকে সরকার দ্রুত অ্যাড্রেস করার চেষ্টা করছে। যারা বাকস্বাধীনতা বা ধর্মীয় স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করছে, তাদেরকে দ্রুতই আইনের আওতায় আনার জন্য ইতিমধ্যেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে এবং সে অনুযায়ী নানা পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতা করার কথা ছিল তা করা হচ্ছে না। আর এর জন্যই নানা সঙ্কট মোকাবিলা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে যত চ্যালেঞ্জ আসছে। আবার অনেকেই সহযোগিতার বদলে উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার সুযোগ নিচ্ছেন-যা মোটেও কাম্য হতে পারে না। আমরা কি পারি না, সবাই একত্রিত হয়ে, সব সঙ্কট মোকাবিলা করে একটি সুন্দর বাংলাদেশ উপহার দিতে? লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |