![]() লন্ডন হবে শনির দিক: নাকি শঙ্কার ঠিকানা?
মীর আব্দুল আলীম:
|
![]() এই বৈঠক ঘিরে উভয়ের এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ‘এজেন্ডা’ নেই-একদিকে এটি স্বস্তিদায়ক, অন্যদিকে বিঘ্নপূর্ণ। অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সংবাদমাধ্যমে বলছেন, “কোনো নির্দিষ্ট ফরম্যাট নেই,” এবং সম্ভাব্য আলোচনাসূচিতে রয়েছে: বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জাতীয় নির্বাচনের সময়সূচি, ‘জুলাই চার্টার’, সংস্কার ইত্যাদি। বিএনপির পক্ষ থেকে এটা “টার্নিং পয়েন্ট”-সম্ভাবনার পথে প্রথম ছোট্ট পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন তারা। বিদ্যমান বিশ্লেষকদের আশাবাদ: সরাসরি সংলাপ ও জান-মাল ও প্রক্রিয়াগত কাঠামো নিয়েও আলাপ হতে পারে, যা গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করবে। এই সাক্ষাৎ হতে পারে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘেরা পথে একটি নতুন মোড়। এই বৈঠক থেকে বাস্তব ফলাফল আদৌ আসবে কি না, তাও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কিন্তু এ একপ্রকার ইঙ্গিত-বাংলাদেশের রাজনীতিতে আড়ালে একটি নতুন সমীকরণ প্রস্তুত হচ্ছে। হয়তো অচিরেই আমরা দেখতে পাব একাধিক ধাপে এমন আরও আলোচনা। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র অনেকাংশে নির্ভর করছে এমন সংলাপ ও সমঝোতার ওপর। ইউনূস-তারেক বৈঠক যদি আন্তরিকতা এবং বাস্তবতা দিয়ে পরিচালিত হয়, তবে এটি হতে পারে একটি অবরুদ্ধ গণতান্ত্রিক পথের পুনরাবিষ্কার। রাজনীতির রসায়ন কখনও সাদামাটা হয় না। বাংলাদেশে তো নয়ই। নানা ঘটনা একদিকে যেমন দৃশ্যমান, তেমনি এর নেপথ্যে চলে অদৃশ্য কূটনীতি, অঙ্ক কষা হয় বড় খাতায়। সেই অঙ্কেই এবার নতুন সংযোজন-লন্ডনে অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমানের সম্ভাব্য বৈঠক। জল্পনা কিন্তু শুরু হয়েছে দিনক্ষণ-১৩ জুন, শুক্রবারের আগেই। প্রশ্ন হলো দু’জনের বৈঠক কি সত্যিই সংকট সমাধানে পথ দেখাবে? অতীতে সেসব আলোচনায় কূটকৌশল ও প্রত্যাশার ফাঁক-ফোকর চিহ্নিত করে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন: লন্ডন বার্তা নয়, বরং আচার-আচরণ ও ফলেই বিচার্য। ড. ইউনূস ও বিএনপি প্রধানের এই বৈঠক শুধুমাত্র সংবাদ শিরোনাম নয়-বরং এটি জনগণের বুকজুড়ে নতুন প্রত্যাশার সঞ্চার করতে পারে। তবে সে প্রত্যাশা বাস্তবে রূপ পায় কি না, সেটাই দেখার বিষয়। এখন শুধু সময়ই বলবে-লন্ডন হবে শনির দিক, নাকি আবার শঙ্কার ঠিকানা? এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক সমঝোতার প্রক্রিয়া যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে তা বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংঘাতের অবসানে এক বড় মাইলফলক হয়ে উঠতে পারে। যদি ইউনুস-তারেক বৈঠক থেকে বেরিয়ে আসা যে কোনো সমঝোতা দেশের সকল রাজনৈতিক শক্তিকে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কাঠামোয় নিয়ে আসতে পারে, তবে এর ইতিবাচক প্রতিফলন শুধু রাজনীতিতেই নয়, দেশের অর্থনীতি, সুশাসন ও সামগ্রিক স্থিতিশীলতায়ও পড়বে। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে, এ পথ মোটেই সহজ নয়। এর পেছনে রয়েছে বহুস্তরীয় জটিলতা, রাজনৈতিক দলের মতপাথ্যক্য, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা। সকল প্রকার শত্রুতা, সংঘাত ও ক্রিমিনালাইজেশন অব পলিটিক্সের প্রেক্ষাপটে এই ধরণের বৈঠক বাস্তব ফল দিতে হলে সকল পক্ষের আন্তরিকতা সবচেয়ে বড় শর্ত। শুধুমাত্র রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়; সেনা-বেসামরিক প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজসহ প্রত্যেকটি স্টেকহোল্ডারকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে হবে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। এই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি মধ্যস্থতা বা নরম-চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে দুই পক্ষকে সমঝোতায় আসতে উৎসাহিত করে, তাহলে সম্ভাবনা অনেক বাড়বে। পাশাপাশি, আঞ্চলিক শক্তি ভারতকেও এখানে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে। কারণ, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকটি কেন তাৎপর্যপূর্ণ? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বহুমাত্রিক অচলাবস্থার মধ্যে ড. ইউনুস আশার আলো দেখাচ্ছেন। তিনি বাংলাদেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মহলে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে উচ্চকণ্ঠ, অন্যদিকে তারেক রহমান বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ক্ষমতার কেন্দ্রে। দেশে নানা ইসুতে আন্দোলন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি নেতাদের কঠোর বক্তব্য, রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তির বৈঠক তাৎপর্যপূর্ণ বটে! অনেকের মতে, এ বৈঠক ভবিষ্যতে বৃহত্তর কোনো সমঝোতা বা আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার ইঙ্গিতও দিতে পারে। আলোচনা কি নিয়ে হতে পারে? বৈঠকটি ঘিরে নানা আলোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো বিবৃতি আসেনি। তবে ঘনিষ্ঠ সূত্রের মাধ্যমে যে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, আলোচনায় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রাধান্য পেতে পারে: ১. দেশের গণতন্ত্র ও দ্রুত নির্বাচন- বিএনপি প্রধান তারেক রহমান ড. ইউনুসের কাছে দ্রুত নির্বাচন দাবি করতে পারেন। বর্তমান আন্তবর্তীকালনি সরকার- জনগনের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ। সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে আওয়ামীলীগ শাসন আমলেরর রাতের ভোট দিনের ভোট হতে পারে এটারও শংকা আছে। তাই সরকার প্রধান সংস্কারের বিষয়টি সামনে আনতে পারেন এবং সে জন্য নির্বাচন কিছুটা বিলম্ব হতে পারে। এ বিষয়টি মানা না মানা নিয়ে দুজনের মধ্যে কথা হতে পারে। ড. ইউনুস কম কথা বললেও তার নীতিতে অবিচল মনে হয়। হেঁসে কথা বললেও বিচক্ষনতার ঘাটতি নেই তাঁর। ব্যক্তিত্বেরতো বটেই! সেক্ষেত্রে ডিসেম্বরের নির্বাচনের বিসয়টি এলে তিনি তা কতটুকু গুরুত্ব দিবেন সেটা দেখার বিষয়। এ প্রেক্ষাপটে দু’জনের আলোচনায় দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কীভাবে অন্তত গ্রহণযোগ্য মানে ফিরিয়ে আনা যায়, সেই আলোচনা হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশেষ করে এই বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের অবস্থানকে কার্যকর করতে উভয়েই সমন্বয় করতে পারেন। আগাম কোনো জাতীয় সংলাপের সম্ভাবনার আলোচনা হতে পারে- বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের স্থায়ী সমাধান হিসেবে আগাম কোন জাতীয় সংলাপ হতে পারে। যা শুধু বিদেশি চাপ বা কূটনীতি দিয়ে সম্ভব নয়- এটা দুই পক্ষই বুঝতে পারছেন। তাই ভবিষ্যতে সরকারের এবং বিএনপির কি করা উচিৎ তা নিয়ে বৈঠকে কথা হতে পারে। সংলাপ বা বোঝাপড়ার সম্ভাবনা নিয়েও দু’জন আলোচনা করেছেন বলে ধারণা। রাজনৈতিক দরগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি: ষড়যন্ত্রের সন্দেহ- এ বৈঠক ঘিরে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সন্দেহ তৈরি হতে পারে। বিভিন্ন মহলে এমনকি জনগনের একটি আংশ এই বৈঠককে ইতিবাচকভাবে দেখার প্রবণতা নেই। অনেকেই মনে করছেন, এটি সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ তৈরি করার নীলনকশারই অংশ হতে পারে। নির্বাচনের সময়সূচি নির্ধারণ বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিএনপির প্রধান দাবি ডিসেম্বর ২০২৫-এর মধ্যেই নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তারা মনে করে ২০১৮ সালের ভোটের মত আরেকটি ‘নির্বাচনী প্রহসন’ ঠেকাতে হলে দ্রুততার সাথে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। অপরদিকে ইউনুসের অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে অবকাঠামোগত ও আইনি সংস্কার ছাড়া অবিলম্বে নির্বাচন দেশকে আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলবে। তারা একটি ধাপে ধাপে সংস্কারের মাধ্যমে ২০২৬ সালের মাঝামাঝি একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে। সময়ের এই তফাতই মূলত পুরো আলোচনার সবচেয়ে বড় গলদ। উভয়পক্ষই তাদের অবস্থানে অনড় থাকলে সমঝোতা অসম্ভব হয়ে পড়বে। দ্রুত নির্বাচন দিলে সরকার এটিকে “বিএনপির ফাঁদ” মনে করে। আর বিলম্বিত নির্বাচনকে বিএনপি দেখে সরকারের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা হিসেবে। এই টানাপোড়েনের অবসান ছাড়া আলোচনার কোনো স্থায়ী ফলাফল সম্ভব হবে না। প্রবাসী রাজনীতির বর্ধিত ভূমিকায় নতুন মাত্রা- প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক ভূমিকা ক্রমেই বড় হচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক সহায়তা নয়, নীতি-পরামর্শ, লবিং ও কূটনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রেও তারা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে প্রবাসী বাংলাদেশিরা আজ সরাসরি রাজনৈতিক আলোচনার এক অনিবার্য অংশ। এই বৈঠকটি লন্ডনে হওয়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতি অনেকটাই আন্তর্জাতিক ডায়াসপোরার হাত ধরে নতুন সমীকরণ খুঁজছে। প্রবাসী সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সম্ভবত এমন একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যস্থতামূলক শক্তি গড়ে তোলারও উদ্যোগ রয়েছে যারা দেশে দীর্ঘস্থায়ী স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার রূপান্তর দেখতে চায়। জনমানসের আশা, সন্দেহ ও প্রত্যাশা- বাংলাদেশের সাধারণ জনগণ দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা আর সংঘাতময় রাজনীতির ক্লান্তিতে ভুগছে। তারা স্থিতিশীলতা চায়, স্থায়ী শান্তি চায়। কিন্তু রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আস্থাহীনতা, চুক্তি ভঙ্গের অতীত অভিজ্ঞতা তাদের মধ্যে সন্দেহও তৈরি করে। এই আলোচনার প্রাথমিক খবর জনগণের মনে যেমন আশার আলো জাগাচ্ছে, তেমনি এটিকে অনেকে দেখছে ‘পুরনো খেলোয়াড়দের নতুন নাটক’ হিসেবেও। তাই এই বৈঠক থেকে যদি কোনো আন্তরিক ও কার্যকর রূপরেখা বেরিয়ে আসে, তাহলেই জনগণের আস্থা বাড়বে। অন্যথায়, এটি আরেকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টায় পরিণত হলে হতাশা আরও ঘনীভূত হবে। উপসংহার: লন্ডনের আলো-আঁধারের এই বৈঠক আপাতত এমন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিলেও উত্তর এখনো অনিশ্চিত। তবে এটুকু স্পষ্ট- বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে বিদেশে আলোচনা নতুন মাত্রা পাচ্ছে। এই আলোচনা কি কোনো সমাধানের দিকে এগিয়ে যাবে, নাকি কেবল আরেকটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে- সময়ই বলবে। তবে ইউনুস-তারেক বৈঠক সংকটের মাঝে নয়া সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করছে। লন্ডনের আলোচনায় রাজনীতির নতুন সমীকরণ হতে পারে। লন্ডনের বৈঠক আপাতত একটি সাদামাটা খবর নয়। এর ঢেউ যে ঢাকার গুলিস্তান, বনানী কিংবা শাহবাগ পর্যন্ত পৌঁছবে, তাতে সন্দেহ নেই। ইউনূস-তারেক বৈঠক আসলে একটি নতুন ডাইমেনশনের নাম-যেখানে রাজনীতি শুধুই দল নয়, বরং প্রক্রিয়া, যেখানে নেতৃত্ব মানেই রণকৌশল, আর যেখানে সমঝোতা মানেই শক্তি সঞ্চয়। বাংলাদেশ কি তবে এক ‘পলিটিক্যাল প্যারাডাইম শিফট’-এর দিকে এগোচ্ছে? মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। |