![]() রোহিঙ্গা সংকট, আরাকান আর্মি ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূরাজনৈতিক সমীকরণ
সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী :
|
![]() রাখাইনের বিচ্ছিন্নতা: বিশ্বশক্তির ভিন্ন স্বার্থ, অভিন্ন লক্ষ্য চীন, ভারত এবং এমনকি পশ্চিমা বিশ্বও রাখাইনকে একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আগ্রহী। তাদের উদ্দেশ্য ভিন্ন হলেও লক্ষ্য এক—নিজ নিজ অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ নিশ্চিত করা। চীনের স্বার্থ: চীন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সাথে যেমন সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে, তেমনি বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকেও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে চীনের গভীর অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ জড়িত। বঙ্গোপসাগরে চীনের প্রবেশাধিকার এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (BRI) অংশ হিসেবে জ্বালানি পাইপলাইন ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রকল্প রাখাইন রাজ্যের স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল। আরাকান আর্মির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চীন এই অঞ্চলে তার প্রভাব বিস্তার করতে চায়। ভারতের স্বার্থ: ভারত প্রাথমিকভাবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও, পরে তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। বিশেষ করে, ভারতের 'কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প'-এর নিরাপত্তার কারণে ভারত শেষ পর্যন্ত আরাকান আর্মির সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয়েছে। এই প্রকল্পটি রাখাইন রাজ্যের সিতওয়ে বন্দর থেকে শুরু হয়ে ভারতের মিজোরাম পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গুরুত্বপূর্ণ করিডোরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভারতের জন্য আরাকান আর্মির সহযোগিতা এখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি স্বাধীন বা স্বায়ত্তশাসিত রাখাইন অঞ্চল ভারতের জন্য এই প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সহায়ক হতে পারে। পশ্চিমা বিশ্বের আগ্রহ: পশ্চিমা শক্তিগুলো শুধু গণতন্ত্র বা মানবাধিকারের বিষয়টিকে সামনে আনলেও, তাদের মূল লক্ষ্য হলো এই অঞ্চলে নিজেদের কৌশলগত প্রভাব বিস্তার করা। সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ এবং চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবিলা করা তাদের ভূরাজনৈতিক এজেন্ডার অংশ। বাংলাদেশের অবস্থান: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনই মূল শর্ত রাখাইন যদি আলাদা রাষ্ট্র হয়, তাহলে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ জটিল। বাংলাদেশ রাখাইনকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে সরাসরি বিরোধিতা করেনি, কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে—রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। রাখাইন যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তাহলে রোহিঙ্গাদের তাদের পৈত্রিক ভিটায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব হতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে একটাই যৌক্তিক শর্ত হতে পারে: "রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নাও, আমরা তোমাদের স্বীকৃতি দেবো।" তবে সমস্যা হচ্ছে, আরাকান আর্মি নিজেরা রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত নিতে আগ্রহী নয়। তারা একটি বৌদ্ধপ্রধান, রোহিঙ্গাবিহীন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখে। এই মনোভাবের কারণে পুরো বিশ্বজুড়ে শুরু হয়েছে এক কূটনৈতিক টানাপোড়েন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আরাকান আর্মির স্পষ্ট অনিচ্ছা বাংলাদেশের জন্য এক বড় চ্যালেঞ্জ। পার্বত্য চট্টগ্রাম: বাংলাদেশের নীরব হুমকি রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ৩টি পার্বত্য জেলার (বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি) দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। এই অঞ্চলগুলোতে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আধিক্য রয়েছে, উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী যা প্রায় ৬৫%। আরাকান আর্মির সংস্কৃতি, ধর্ম এবং জাতিগোষ্ঠীগত মিল থাকার কারণে তারা এই অঞ্চলকে নিজেদের 'প্রাকৃতিক সম্প্রসারণ' হিসেবে দেখতে পারে। অতীতে যখন আরাকান আর্মি ভারত ও মিয়ানমারের যৌথ অভিযানে কোণঠাসা হয়েছিল, তখন এই তিন পার্বত্য জেলাই ছিল তাদের নিরাপদ আশ্রয়। সুতরাং, আজ যদি রাখাইন আলাদা হয় এবং আরাকান আর্মি শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাহলে ভবিষ্যতে পার্বত্য চট্টগ্রামও তাদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠতে পারে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের ভূখণ্ডীয় অখণ্ডতা এবং চট্টগ্রাম বন্দরের নিরাপত্তাও ঝুঁকিতে পড়বে। আরাকান আর্মি যদি পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তবে এটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুতর নিরাপত্তা হুমকি সৃষ্টি করবে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত হানবে। পশ্চিমা আগ্রহ: খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের নেপথ্য পরিকল্পনা? ২০২৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, "পশ্চিমারা এই অঞ্চলে একটি খ্রিস্টান রাষ্ট্র তৈরি করতে চায়।" এই কথাটি হয়তো উপেক্ষা করার মতো নয়। মনিপুর, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম এবং মিয়ানমারের চিন রাজ্য—এই অঞ্চলগুলোতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ৮৫-৯০% এর ওপরে। চিন রাজ্যের খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর মধ্যে দিয়েই কালাদান প্রকল্প ভারতের মিজোরামে প্রবেশ করেছে। এই এলাকাগুলোকে ঘিরেই হয়তো একদিন গঠিত হতে পারে একটি খ্রিস্টানপ্রধান স্বাধীন রাষ্ট্র। এর জন্য প্রয়োজন একটি সমুদ্রবন্দর—যা রাখাইন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের দিক দিয়েই সবচেয়ে সহজলভ্য। পশ্চিমা শক্তিগুলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে, যেখানে এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা তাদের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে। একটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র গঠন করা গেলে তা এই অঞ্চলের ধর্মীয় ও জাতিগত সমীকরণে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে। জাতিসংঘ ও স্টারলিঙ্ক: 'সহযোগিতা'র মোড়কে স্বীকৃতি প্রস্তুতি? আজ জাতিসংঘ, স্টারলিঙ্ক এবং বিভিন্ন বিদেশি সাহায্যকারী সংস্থাগুলোর রাখাইনে আগমন কেবল মানবিক নয়, বরং এর পেছনে কৌশলগত উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। রাখাইন যদি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চায়, তাহলে তাকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে হবে। এই স্বীকৃতির বড় শর্ত হবে—একটি গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠন এবং রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া। এই অবস্থায় পশ্চিমারা বা জাতিসংঘ হয়তো সরাসরি কিছু বলছে না, কিন্তু চাপ প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমনকি ধারণা করা হচ্ছে, নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের মাধ্যমেও কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু হয় এবং রাখাইন একটি স্থিতিশীল ও জনবান্ধব রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্টারলিঙ্কের মতো প্রযুক্তিগত সহায়তার উপস্থিতি এই অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাব বিস্তারের একটি কৌশলগত দিক হতে পারে। শেষ কথা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মির উত্থান ও সম্ভাব্য স্বাধীনতা, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংযোগ এবং আন্তর্জাতিক মহলের কৌশলগত স্বার্থ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য এখন এক জটিল ভূরাজনৈতিক পরীক্ষা। এই অঞ্চলের প্রতিটি আন্দোলন বা স্বাধীনতা ঘোষণা যতটা তাদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে, তার চেয়ে অনেক বেশি অন্য দেশের করিডোর, বন্দর ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ঘিরে। বাংলাদেশ যদি এখনই জাতীয় কূটনীতিকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে প্রস্তুতি না নেয়, তবে ভবিষ্যতে শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, দেশের ভূখণ্ডগত নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই, একটি সুদূরপ্রসারী এবং বিচক্ষণ কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাংলাদেশের জন্য অপরিহার্য। এই অঞ্চলে যেকোনো পরিবর্তনের দিকে নিবিড় নজর রাখা এবং সম্ভাব্য সব পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকা অত্যন্ত জরুরি। সাখাওয়াতুল আলম চৌধুরী : গবেষক, কলামিস্ট |