![]() সিলেটে হাজার কোটি টাকা লুটপাট: প্রকৃতি এখন অভিশাপ!
মাহফুজ বিন মোবারকপুরী:
|
![]() এই লেখাটি কোনো সাধারণ নগর-সমস্যার বিবরণ নয়; এটি দীর্ঘ দিনের উপেক্ষা, লুটপাট ও প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে একটি দলিল। সিলেটের নাগরিকদের যন্ত্রণার মুখপাত্র হয়ে এই লেখাটি লেখার দায়বদ্ধতা অনূভব করেছি। কারণ এখন শুধু আর বর্ষা নয়—প্রতিটি বৃষ্টিই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে দুর্নীতি আমাদের শহর, আমাদের ভবিষ্যৎকে ডুবিয়ে দিয়েছে। সিলেট শহরের চিত্র দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহভাবে উপেক্ষিত। প্রতি বর্ষায় এই শহর যেন ডুবে যায় দুর্নীতি, দখল আর প্রশাসনিক ব্যর্থতার সমুদ্রে। নগরের প্রধান সমস্যা হলো জলধার ধ্বংস করে অপরিকল্পিত হাউজিং প্রকল্প ও সড়ক নির্মাণ, খাল ও ছড়া দখল এবং পানি নিষ্কাশনের কার্যকর নেটওয়ার্কের অভাব। ২০১২ সাল থেকে সিলেট সিটি করপোরেশন “জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্প” নামে একাধিকবার বাজেট বরাদ্দ পেলেও তা বাস্তবে পরিণত হয়নি। ২০১৬–২০২১ মেয়াদে এডিবি ও বিশ্বব্যাংকসহ স্থানীয় উৎস থেকে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা এসেছিল খাল সংস্কার ও ড্রেন নির্মাণের নামে। কিন্তু প্রকল্পের বেশিরভাগই কাগজে কলমে থেকে গেছে। যেটুকু হয়েছে, তা এতই নিম্নমানের যে এক মৌসুমেই উবে গেছে। ২০১৯ সালে তালতলা, জিন্দাবাজার, আম্বরখানা, টিলাগড়, সুবিদবাজার, বাদাঘাট—এসব এলাকায় এক ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। মানুষ ফেসবুকে লিখে ফেলে, “সিলেট কি ভেনিস হয়ে গেল?” অথচ সিটি করপোরেশন তখন ৩২০ কোটি টাকার খাল উন্নয়ন প্রকল্পের কথা বলেছিল, যা বাস্তবায়িত হলে এসব সমস্যা থাকার কথা না। আজ ২০২৪, সেই প্রকল্পের এক-তৃতীয়াংশও শেষ হয়নি, বরং সমস্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যাও প্রকৃতিক ছিলোনা, ছিল এক ‘ম্যান মেড ডিজাস্টার’। পাহাড়ি ঢল ও দখলকৃত খাল-ছড়ার কারণে পানি বের হতে পারেনি। অথচ সমস্যার মূল খুঁজে না পেয়ে সরকার নতুন “বন্যা প্রতিরোধ প্রকল্প” হাতে নেয়, যার মধ্যে শুধু সিলেটেই বরাদ্দ হয় ১২৫০ কোটি টাকা। দুই বছর পর দেখা গেল প্রকল্পের ৪৫% কাজই শুরু হয়নি, বাকিটা ছিল কেবল দরপত্রের টাকা ভাগাভাগি। ঢাকার আরডিআরসির মতো গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিলেটে না থাকলেও, স্থানীয় সংগঠন “নগর দর্পণ” ২০২৩ সালে জরিপ চালিয়ে দেখে, অন্তত ১৭টি খাল ও ছড়া দখল হয়ে গেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। তালতলা, ঝালোপাড়া, কাজীরবাজার, মদিনা মার্কেট, শেখঘাট, মধুশহীদ—এসব এলাকায় পানি যাওয়ার ন্যূনতম পথও নেই। অথচ এসব খাল একসময় বর্ষার পানি প্রবাহের প্রধান মাধ্যম ছিল। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফা ক্ষমতা গ্রহণের পর “উন্নয়ন” শব্দটি became synonymous with বাজেট, বরাদ্দ, প্রকল্প ও পিআর। কিন্তু এই উন্নয়ন কোথায় হয়েছে? রাস্তাঘাট, সেতু, ফ্লাইওভার, ড্রেনেজ, খাল সংস্কার ইত্যাদি প্রকল্পের নামে যে বিপুল অঙ্কের টাকা ব্যয় হয়েছে, তার ফলশ্রুতিতে ঢাকার মতো নগরে কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতেই হাঁটু পানি জমে যায়, মানুষ ঘরে ফিরতে পারে না। এ যেন এক প্রাত্যহিক দুর্ভোগ। অথচ কাগজে কলমে খরচ হয়েছে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি! আর এই অবস্থা শুধু ঢাকা বা সিলেট শহরের নয়; চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী—সব শহরের ছবি প্রায় একই। ঢাকা শহরে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০১০ সালের পরপরই একাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রতিশ্রুতি দেন, “আগামী বছর থেকে জলাবদ্ধতা থাকবে না।” কিন্তু ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিটি বর্ষায় শহরের মানুষ ডুবেছে পানিতে। ঠিক তেমনি সিলেট শহরের মানুষ আতঙ্কে থাকে নতুন কোনো প্রকল্প ঘোষণার পরই, কারণ প্রকল্প মানেই খোঁড়াখুঁড়ি, নিম্নমানের কাজ, টাকা আত্মসাৎ এবং বর্ষায় এক চরম দুর্ভোগ। ঢাকায় ২০২০ সালের শেষে ওয়াসা থেকে খাল ও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সিলেটে এখনো এলজিইডি, ওয়াসা, সিটি করপোরেশন, ঠিকাদার—সব মিলে এক বিশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় কাজ চলে, নেই কোনো সমন্বয় বা জবাবদিহিতা। ঢাকায় খাল ও লেক দখল করে বস্তি উচ্ছেদ বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে প্রতিনিয়ত হচ্ছে দলীয় দুর্বৃত্তায়ন। কদমতলী, রামপুরা, দোলাইখাল, রায়েরবাজার—এসব এলাকায় কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ হয়, কাজ শুরু হয় না। আর শুরু হলেও টেকে না। গত ছয় বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার ১৫টি খাল পুনর্গঠনের প্রকল্পে ১০০ কোটি টাকারও কাজ হয়নি বলে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে। ঢাকায় এই দুর্নীতি যেখানে প্রমাণিত, সিলেটে কোনো নিরীক্ষাই হয় না। প্রকল্প শুরু হয়, শেষ হয় না, আবার নতুন প্রকল্প আসে—দায়বদ্ধতার চিহ্নমাত্র নেই। অর্থাৎ ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ঢাকার তিন হাজার কোটি আর সিলেট অঞ্চলের এক হাজার কোটি টাকা মিলে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট হয়েছে শুধুমাত্র খাল-ড্রেন-জলাবদ্ধতা ইস্যুতে। তবু শহরগুলো বৃষ্টিতে ভাসে, মানুষ কাদাপানিতে হাঁটে, সরকারি ওয়েবসাইটে দেখা যায় '৯৫% কাজ শেষ' লেখা থাকে। এ যেনো এক রাষ্ট্রীয় প্রতারণার মহোৎসব। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তী সরকার যে কাজগুলো হাতে নিয়েছে, তার মধ্যে খাল খনন ও ব্লু নেটওয়ার্ক গঠন অত্যন্ত সময়োপযোগী। ঢাকা শহরের ২১ কিলোমিটার জলাশয় পুনরুদ্ধার এবং সিলেটে ১৭টি খাল পুনর্গঠন যদি এই সরকারের অধীনে সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন হয়, তবে এই শহরগুলো বাঁচতে পারে। তবে তার জন্য দরকার দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ, বিকেন্দ্রীকৃত ও জনসম্পৃক্ত ব্যবস্থাপনা—যা গত ১৬ বছরে শুধু কথার ঝুড়িতেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। মাহফুজ বিন মোবারকপুরী: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, সমালোচক। |