![]() রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() তাছাড়া বেসরকারি খাতের ওপর চাপ বাড়ছেই। কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি নেই। দেশে বেকারত্ব আরো বেড়েছে। বর্তমানে দেশে বেকার ২৭ লাখ ৩০ হাজার। চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেকারত্বের হার বেড়ে ৪ দশমিক ৬৩ শতাংশে পৌঁছেছে বলে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে উঠে এসেছে।এমন পরিস্থিতিতে প্রয়োজন এমন পথে যাত্রা করা, যা সবার আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার নিশ্চিত করবে। এগুলো নিশ্চিত হলে তা অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা রাখা যায়। দেশের সার্বিক উন্নয়নে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নয়তো প্রবৃদ্ধি টেকসই হয় না। এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হলো বর্তমান বাংলাদেশ। বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনামলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা পুরো ভিন্ন, যার পুরোটা এ সরকার পতনের পর ক্রমে সামনে এসেছে। স্বাভাবিক নিয়মে উন্নয়ন বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিল্প খাতের কর্মকাণ্ডেও প্রবৃদ্ধি ঘটে। অথচ বাস্তবে সমসাময়িক প্রতিযোগী অর্থনীতিগুলোর তুলনায় বিনিয়োগ, রফতানি, মানব সম্পদ উন্নয়ন, বিদেশী বিনিয়োগ ও ব্যবসার পরিবেশসহ বিভিন্ন সূচকেই পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ পিছিয়ে পড়া মূলত রাষ্ট্রের সক্ষমতার অভাবকে নির্দেশ করে, যেটি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) সাম্প্রতিক গবেষণায়ও উঠে এসেছে। হোয়াটস আর দ্য রিস্কস টু সাসটেইনড ইকোনমিক গ্রোথ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে দুই দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও রাষ্ট্রের সক্ষমতা সেভাবে বাড়েনি। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ক্রমেই ভঙ্গুর হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে দীর্ঘ সময়ের দুঃশাসনকে। আরো বলা হয়েছে, বিদ্যমান ধারা বজায় থাকলে ভবিষ্যতেও রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা খুব বেশি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। আর রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা সংহত না হলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও টেকসই হয় না। ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সরকার পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটতে পারে। উল্লেখ্য, এ গবেষণায় উৎপাদনশীলতা বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, প্রশাসনিক সক্ষমতা এবং সামাজিক সাম্যকে চার লেনের একটি উন্নয়নের মহাসড়কের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সরকারের কার্যকারিতা, আইনের শাসন, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ, নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মান-এ সূচকগুলো ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা সমান্তরালে না থাকলে তা নানা ধরনের অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়, যা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ও দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে প্রতীয়মান হয়। তাই রাষ্ট্রের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বলতে মূলত বোঝানো হয়-আইনের শাসন, সরকারের কার্যকারিতা, দক্ষ আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। কোনো রাষ্ট্রের এসব ক্ষেত্রে দুর্বলতার অর্থ হলো, সেখানে জনগণ কখনো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল ন্যায্যভাবে পান না। সেখানে দুর্নীতিকে লালন করা হয় এবং দেশ অগণতান্ত্রিক ধারায় চলতে থাকে। প্রশাসন হয়ে ওঠে সে ধারার অন্যতম বাহন। ফলে দীর্ঘমেয়াদে রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকির মুখে পড়ে। দুঃখজনকভাবে এসব ক্ষেত্রে দেশের কাঠামো বেশ দুর্বল ও বর্তমানে ভঙ্গুর প্রায় পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে। বিশেষত সুশাসনের অভাব এখানে স্পষ্ট এবং এর অভাব এতটাই যে স্বাধীনতার পর ৫৪ বছরে এ দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাত এত বেশি সমস্যার মুখোমুখি আর কখনো হয়নি। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বানোয়াট পরিসংখ্যান, ঋণ জালিয়াতি, অবৈধ অর্থ পাচার থেকে শুরু করে শেয়ারবাজারে কারসাজিসহ অর্থনীতির প্রায় প্রতিটি খাতেই চলেছে দুর্বৃত্তপনা। তারল্য সংকটে পড়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত থেকে শুরু করে আধা সরকারি ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক। খেলাপি ঋণের হার অসহনীয় মাত্রায় বেড়ে গেছে। সরকারি ঋণপ্রবাহ বেড়ে গিয়েছিল। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমায় বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ে। বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। ব্যাংকের মাধ্যমে আসা বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ কমে গিয়েছিল এবং বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে দেখা দিয়েছিল আস্থার সংকট। ভেঙে পড়েছিল পুরো আর্থিক খাত। অর্থাৎ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের প্রভাবে প্রতিটা প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে পড়ে।অতিমাত্রায় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিকীকরণ করা হয়েছে। একদিকে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের এ পরিস্থিতি, অন্যদিকে রাজস্ব আহরণেও রয়েছে দুর্বলতা। প্রতি বছরই লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম রাজস্ব আয় হয়। প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে জনগণের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। তেমনি সরকারি ব্যয়ও নানা অনিয়ম ও অপচয় করা হয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে জনস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়েই। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিও ছিল না। এতে এসব প্রকল্পই হয়ে উঠেছিল অর্থ লোপাটের বড় উৎস। আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন প্রকল্পে জনবল বা ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অদক্ষ ব্যক্তি বা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের ফলে সেগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়নও হয়নি। এতে কেবল ব্যয় বেড়েছে।এসব ধারা থেকে বের হওয়া জরুরি। এ দেশের অর্থনীতির আকারের সমপর্যায়ের দেশে যারা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পেরেছে,যেমন ভিয়েতনাম বা ইন্দোনেশিয়া, তারা রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর সমান গুরুত্ব দিয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন, কর ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রকৃত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে নীতি প্রণয়ন ও বিচারিক কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও সরকারি ব্যবস্থাপনার কার্যকারিতা নিশ্চিতের মাধ্যমে এসব দেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় ভারসাম্য বজায় রেখেছে। বাংলাদেশকেও এ পথে হাঁটতে হবে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে। জনগণের রাষ্ট্রীয় অধিকার ভোট এবং এটি সরকার ও রাষ্ট্রের সেতুবন্ধস্বরূপ। ভোটের সঙ্গে প্রাপ্তির সরাসরি সংযোগ না থাকায় অধনী দেশে ভোটের গুরুত্ব জনসাধারণ মূল্যায়ন করে না। নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব না হলেও বর্তমানে ভোটদানে অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য জনগণকে আহ্বান করতে হয়। অথচ উত্সাহ-উদ্দীপনার মধ্যেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। এটিই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কাস্টেড ভোটের সংখ্যাকে গুরুত্ব দেওয়া হলে গণতন্ত্রের বিদ্যমান দূষণ কিছুটা হলেও দূর হবে। রাজধানী, সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ইত্যাদির অবদান বা জনগণের প্রাপ্ত উপকার একজন ব্যক্তির অবস্থানগত দূরত্বের কারণে কমতে থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় এসব সম্পদের উপকার পাওয়ার অধিকার সব নাগরিকের সমান এবং রাষ্ট্রই ঐ অধিকারপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবে। এজন্য যোগাযোগব্যবস্থার আরো উন্নয়ন প্রয়োজন। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে।বাজেটে এলাকাভিত্তিক বরাদ্দ প্রদান অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিতে পারে। মনে রাখতে হবে, দ্রুত ও অধিকতর অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনের জন্য বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। উন্নত দেশ হতে হলে বাংলাদেশের দ্রুত সার্বিক উন্নয়ন অর্জন করতে হবে। এজন্য নির্বাচনি এলাকাভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশের জন্য উন্নয়ন যেন শুধু প্রতিশ্রুতিতেই আবদ্ধ না থেকে, উন্নয়ন এবং অগ্রগতির ধারা যেন দৃশ্যমান সাফল্যে রূপান্তরিত হয়। একমাত্র শক্তিশালী রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একসাথে মিলিত হলে, তা বাংলাদেশের প্রকৃত সমৃদ্ধির মূল চাবিকাঠি হবে। কেননা, উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন রাজনীতি তার দায়িত্বশীল অবস্থান গ্রহণ করে, প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। তাই দেশ এবং জাতির স্বার্থে, প্রতিপক্ষের ধ্বংসে নয়, রাষ্ট্রের নির্মাণে মনোনিবেশ করা উচিত। প্রতিহিংসার গণ্ডি ভেঙে, টেকসই ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। কারণ টেকসই উন্নয়ন কোনো দলের নয়, এটি পুরো জাতির, এটা মনে রাখতেই হবে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |