![]() রাজা চার্লসের আমন্ত্রণে ড.ইউনূসের যুক্তরাজ্য সফর
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() এ ছাড়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণসহ সংস্কার কার্যক্রমে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক সমর্থনের বিষয়টি গুরুত্ব পাবে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের নৃশংসতার বিচার, সংস্কার এবং নির্বাচনের পরিক্রমায় এগিয়ে যাওয়ার উদ্যোগে যুক্তরাজ্যের সমর্থনের বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে। প্রধান উপদেষ্টা লন্ডন সফরের সময় ১১ জুন যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউজ আয়োজিত এক সংলাপে অংশগ্রহণ করবেন। ওই সংলাপের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে;বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথে চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা। রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গত ৮ই আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। যার প্রধান হন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পর বিদেশসফরে বৃটেন হবে ড. ইউনূসের ১১তম গন্তব্য। ১০ মাসে তিনি ১০টি দেশ সফর করেছেন। যার সূচনা ছিল গত সেপ্টেম্বরে, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের মধ্যদিয়ে। আর শেষ অর্থাৎ দশম সফর হয়েছে বিদায়ী মে মাসের সমাপনীতে জাপানে। নিউ ইয়র্ক সফরে তার গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক ছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেসসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টার দ্বিতীয় বিদেশ সফর ছিল আজারবাইজানের বাকুতে। ১১ থেকে ২২শে নভেম্বর। জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে অংশগ্রহণ ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে সাইড লাইনে তার সিরিজ অব মিটিং হয়। তৃতীয় বিদেশ সফর ছিল মিশরের কায়রোতে। ১৮ থেকে ২০শে ডিসেম্বর। উপলক্ষ ডি-৮ সম্মেলনে অংশগ্রহণ। চতুর্থ সফর ছিল সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে। ২১ থেকে ২৫শে জানুয়ারি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে অংশগ্রহণ। পঞ্চম সফর ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যিক শহরে দুবাইতে।ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিট ছিল সেখানে। মার্চে ছিল তার বহুল আলোচিত চীন সফর। ৬ষ্ঠতম ওই সফরটি ছিল মূলত দেশটির হাইনানে। উপলক্ষ বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার মতো বহুপক্ষীয় আয়োজনে অংশগ্রহণ। সেইসঙ্গে তিনি বেইজিং সফর করেন। সেখানে প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংসহ চীনের গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয় তার। বেইজিং সফর ছিলো ড. ইউনূসের প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। চীন থেকে ফেরার পর থাইল্যান্ড যান ড. ইউনূস। এটি ছিলো তার সপ্তম সফর। উদ্দেশ্য বিম্সটেক সম্মেলনে যোগদান। ৩ থেকে ৪ঠা এপ্রিলের ব্যাংকক সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রথম বৈঠক হয় তার। ২১ থেকে ২৫শে এপ্রিল আর্থনা সম্মেলনে যোগ দিতে কাতারে যান তিনি। ২৬শে এপ্রিল সেখান থেকে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে ভ্যাটিকান সিটি যান ড. ইউনূস। সর্বশেষ ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ফিউচার অব এশিয়ায় অংশগ্রহণ করতে জাপানের টোকিও সফর করেন। ২৮ থেকে ৩১শে মে’র সফরটিতে দ্বিপক্ষীয় উপাদান যুক্ত ছিলো। বিশেষ করে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠকটি ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। দশ মাসে ১০ সফরের মধ্যে কোনো রাষ্ট্রীয় সফর ছিল না। তবে জুলাই’র মাঝামাঝিতে ড. ইউনূসের প্রস্তাবিত মালয়েশিয়া সফরটি স্টেট ভিজিট হতে পারে বলে আভাস মিলেছে। সম্প্রতি গার্ডিয়ানের রিপোর্টে বলা হয়েছে, শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠরা যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি ক্রয় করতে বিপুল অর্থ ব্যয় করেছেন। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে যুক্তরাজ্যে সফরে রয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই সফরে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হবে। সেজন্য প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর ও দুর্নীতি দমন কমিশনের বা দুদক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মোমেনও। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যে সে অর্থ পাচার হয়ে এসেছে, সেটিকে কিভাবে ফেরত আনা যায়-সেটি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গীরা কাজ করছেন। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের দুর্নীতি নিয়ে অধ্যাপক ড.মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিটি যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করেছিল তাতে দেখা যায়, বিগত শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার হয়েছিল বিদেশে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিগত শাসনামলে বিদেশে পাচারকৃত অর্থের একটা বড় অংশই পাচার হয়েছে যুক্তরাজ্যে। যে কারণে প্রধান উপদেষ্টার এই সফরকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন তারা। এদিকে প্রধান উপদেষ্টার এই সফর ঘিরে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা- ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি, স্পটলাইট অন করাপশন ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল-ইউকে। দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,এই অর্থ যে অবৈধভাবে পাচার হয়েছে, তারপর লগ্নি হয়েছে, এটা কিন্তু আদালতে প্রমাণ করতে হবে। গণমাধ্যমে পাঠানো এই বিবৃতিতে স্পটলাইট অন করাপশনের নির্বাহী পরিচালক সুসান হাওলি বলেছেন,'সময় অপচয় না করে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাজ্য সরকারের উচিত বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ জব্দে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ ও অর্থ পুনরুদ্ধারে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে।' এই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, দ্য অবজারভার ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে'র তদন্তে শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজনদের যুক্তরাজ্যে মালিকানাধীন কমপক্ষে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পত্তির সন্ধান পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) ইতিমধ্যে ৯০ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের সম্পদ জব্দ করেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ইউকে'র পলিসি ডিরেক্টর ডানকান হেমস বলেন, "বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘনিষ্টজনদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত যুক্তরাজ্যে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ড সম্পদের যে তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, যথাযথভাবে অনুসন্ধান করে যুক্তরাজ্য সরকারকে তা জব্দ করতে হবে। আমাদের বর্তমান যে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ মুহূর্তে এসে দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরাই দায়িত্ব দিয়েছি। রাজনৈতিক দিক থেকে কিন্তু তাদের অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নয়। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তারা সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ মানুষ। পণ্ডিত লোক। পলিটিক্যাল উইশডম পুরোপুরি আছে সে কথা বলা যাবে না। তবে তাদের আন্তরিকতার অভাব আছে বলে আমার কাছে মনে হয় না। তারা কাজ করতে চান, কাজ করার চেষ্টা করছেন। দৃষ্টিভঙ্গী ভিন্ন হতে পারে, তবে এখানে একটি ইউনিক ব্যাপার আছে-এখানে একটা চাপ আছে।এখানে নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন রাজনৈতিক চিন্তা আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করে একটা জায়গায় নিয়ে আসা, এটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জিং কাজ। সেখানে একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে, দুই নেতার আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান হয়ে যেতে পারে। মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট শাসনে আওয়ামী লীগ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নতুন করে গড়ে তোলা কিন্তু ছেলেখেলা নয়! এটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও অধ্যাপক ইউনূস ও তারেক রহমান বৈঠকটিকে একটি মাইলফলক মনে করছেন। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |