![]() ট্রাম্প-সালমান কথোপকথনে বিশ্ব কী বার্তা পেল
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() ট্রাম্পের এই সফরের মাধ্যমে জ্বালানি, গুরুত্বপূর্ণ খনিজ, অবকাঠামো এবং উন্নত প্রযুক্তির মতো মার্কিন খাতে ৬০০ বিলিয়ন ডলারের সৌদি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি আনুষ্ঠানিকভাবে উত্থাপিত হয়েছে। পূর্ব নীতিগতভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এ বিনিয়োগগুলো এখন কার্যকর করা হচ্ছে। এতে সৌদি ভিশন-২০৩০ এর বৈচিত্র্যকরণ লক্ষ্যগুলো এবং অর্থনৈতিক-নির্ভরতা শক্তিশালী হয়। মার্কিন সংস্থাগুলোর মূলধন প্রবাহ, শিল্প অংশীদারত্ব এবং যৌথ উদ্ভাবনী উদ্যোগ অনেক বাড়বে। ট্রাম্পের সফরের সময় অনুষ্ঠিত সৌদি-মার্কিন বিনিয়োগ ফোরামে ইলন মাস্ক, জেনসেন হুয়াং এবং ল্যারি ফিঙ্কসহ আমেরিকান সিইওদের উপস্থিতি সৌদি আরবের অর্থনৈতিক গতিপথের প্রতি বেসরকারি খাতের ক্রমবর্ধমান আস্থাকে তুলে ধরে। জ্বালানি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড কম্পিউটিং, লজিস্টিকস এবং উন্নত উৎপাদনের মতো বিষয়গুলোর চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা সৌদি উন্নয়ন পরিকল্পনায় আমেরিকান প্রযুক্তিগত নেতৃত্ব অনেক গুরুত্ব পেয়েছে।প্রতিরক্ষা বিষয়ে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি পুনর্গঠিত কৌশলগত এজেন্ডার কেন্দ্রবিন্দু। এটি সৌদি আরবকে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা, মানুষবিহীন বিমানব্যবস্থা, সাইবার নিরাপত্তা এবং স্থানীয় অস্ত্র উৎপাদনে উন্নত ক্ষমতা প্রদান করে। এটি সৌদি আরবের প্রতিরোধমূলক অবস্থান এবং অপারেশনাল প্রস্তুতি বৃদ্ধি করেছে। বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান আঞ্চলিক হুমকি এবং অস্থিতিশীলতার জন্য এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এ চুক্তি উপসাগরীয় নিরাপত্তার নোঙর হিসেবে সৌদি আরবের ভূমিকার প্রতি আমেরিকানদের নতুন আস্থার ইঙ্গিত বহন করে। মার্কিন সামরিক সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য দেওয়া এবং উপসাগরীয় মিত্রদের সুরক্ষার জন্য প্রস্তুতির বিষয়ে ট্রাম্পের স্পষ্ট পুনর্ব্যক্তকরণ করে। ফলে পূর্ববর্তী মার্কিন প্রশাসনের সময় ভেঙে পড়া আস্থা পুনরুদ্ধার হওয়ার পথে। এ সফর ইরানের ব্যাপারেও ঐক্য নিশ্চিত করেছে। ট্রাম্প সৌদি আরবের উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তেহরানের সামনে দুটি বিকল্প পথ রয়েছে: আচরণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে পুনঃএকত্রীকরণ অথবা বিচ্ছিন্নতা থাকা। মার্কিন-উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ শীর্ষ সম্মেলনে তার বক্তব্য সৌদি নেতৃত্বের সংস্কার এবং ইরানের দুঃসাহসিকতার মধ্যে বৈপরীত্যের ওপর বেশি জোর দেয়, যা কৌশলগত ঐক্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত বলে বোঝা যায়।ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং তার আঞ্চলিক প্রতিনিধিদের ওপর চাপ প্রয়োগে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় চেষ্টা করে যাচ্ছে। এদিকে সৌদি আরব একটি সুনির্দিষ্ট নীতি বজায় রেখেছে যা কূটনৈতিক চ্যানেলগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। এর মধ্যে রয়েছে চীনের অতিরিক্ত তোষামোদি এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা সম্পর্কের মধ্যে একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ মূলক কাঠামো স্থাপন করা। শীর্ষ সম্মেলনের বার্তায় পুনর্নির্মিত উপসাগরীয় নিরাপত্তা কাঠামোর উত্থান তুলে ধরা হয়েছে যেখানে সৌদি আরবের ইচ্ছা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দিক হলো সিরিয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভিঙ্গির পরিবর্তন। রিয়াদে সৌদি আরবের নতুন প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারার সঙ্গে ট্রাম্পের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক যা যুবরাজের সহায়তায় হয়েছিল। এটি ছিল আরব-নেতৃত্বাধীন স্বাভাবিকীকরণ প্রচেষ্টার প্রতীক। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া এবং সিরিয়ার উত্তরণের বিষয়টি আঞ্চলিক নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে। ওয়াশিংটন সংঘাত-পরবর্তী কূটনীতিতে রিয়াদের কেন্দ্রীয় ভূমিকাকে পরোক্ষভাবে স্বীকার করে নিয়েছে।পুনর্গঠন, স্থিতিশীলতা ও আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যায়ক্রমে পুনঃএকত্রীকরণকে অগ্রাধিকার দিয়ে সিরিয়ার বিষয়ে আরব লীগের ঐকমত্য গঠন করেছে সৌদি আরব। এর ফলে অভ্যন্তরীণ আরব ঐকমত্য এবং বিশ্বব্যাপী ভারসাম্য বজায় রাখতে কূটনৈতিক মধ্যস্থতাকারী হিসেবে সৌদি আরবের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে তুলে ধরা হয়েছে।ফিলিস্তিন ইস্যুতে ট্রাম্প শান্তির দিকে অগ্রগতিকে উৎসাহিত করছেন। কিন্তু ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিকীকরণ করা বা উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর বৃহত্তর কৌশলগত সম্পর্কের ওপর নির্ভর করা এড়িয়ে গেছেন তিনি। পরিবর্তে, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন স্বাভাবিকীকরণ আঞ্চলিক পক্ষগুলোর মাধ্যমেই হওয়া উচিত তা সৌদি আরব বা সিরিয়া হোক তা তাদের পছন্দে হতে হবে। মার্কিন-জিসিসি শীর্ষ সম্মেলনে উপসাগরীয় নেতারা বিশেষ করে যুবরাজ ২০০২ সালে আরব শান্তি উদ্যোগে ১৯৬৭ সালের সীমান্তের ভিত্তিতে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সংঘাতের দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে পুনর্ব্যক্ত করেছিলেন। মধ্যপ্রাচ্য শান্তি মীমাংসার বৃহত্তর ইস্যুতে ট্রাম্পের অস্পষ্টতা রিয়াদকে মূল্যবান কৌশলগত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে। এটি আরব শান্তি উদ্যোগে ফিলিস্তিনদের অধিকারের বিষয়ে তার নীতিগত অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করার সুযোগ করে দিয়েছে। একই সঙ্গে চূড়ান্ত অবস্থা আলোচনার জন্য বাইরের সংযোগ থেকে মুক্ত হয়ে নিজস্ব গতিতে স্বাভাবিকীকরণ করার চেষ্টা সম্মতি পায়। এ পদ্ধতি কেবল সৌদি কূটনৈতিক নমনীয়তাকেই শক্তিশালী করে না বরং আঞ্চলিক শান্তি প্রচেষ্টায় এটিকে বিশ্বাসযোগ্য এবং স্বায়ত্তশাসিত নেতা হিসেবেও অবস্থান করে দেয়।ফলে দেখা যায়, বৃহত্তর নীতি পুনর্বিন্যাসের ইঙ্গিত দেয়। কারণ মার্কিন-সৌদি সম্পর্ক বিশেষ করে জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা সম্পর্কের বাইরে বিনিয়োগ, আঞ্চলিক কূটনীতি এবং নিরাপত্তা সমন্বয়কে অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাপক কৌশলগত অংশীদারত্ব বিকশিত হয়। সৌদি আরব এখন অনেক আঞ্চলিক উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে একজন সহায়ক ও নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে পুনঃস্থাপন করছে। ঐতিহাসিকভাবে সৌদি-যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদারত্ব শীতল যুদ্ধের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, তেলের ঝুঁকি, সন্ত্রাসবাদ এবং কূটনৈতিক টানাপোড়েনকে প্রতিহত করেছে। যেমনটি তার প্রথম মেয়াদে হয়েছিল। দ্বিতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পর ট্রাম্পের রিয়াদে প্রত্যাবর্তন এ জোটের স্থায়িত্বকে বাড়িয়ে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্য নীতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী বিচ্ছিন্নতার সংশোধনও হয়েছে। সৌদি আরবের ভিশন-২০৩০, দেশের সামাজিক সংস্কার এবং আঞ্চলিক সম্পৃক্ততায় তার দ্ব্যর্থ সমর্থন তেল-নির্ভর রক্ষণশীলতা থেকে গতিশীল অবস্থা ফিরে পায়। হোয়াইট হাউসের সৌদি আরবের নেতৃত্বের প্রতি স্বীকৃতি এক ধরনের বড় বার্তা দেয়। আত্মবিশ্বাসী সৌদি আরব আঞ্চলিক ও বিশ্বব্যাপী স্থিতিশীলতার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। রিয়াদের পররাষ্ট্রনীতি ক্রমশ ভারসাম্য ও বৈচিত্র্যের ওপর জোর দিচ্ছে। সৌদি আরব চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করেছে। ভারতের সঙ্গে জ্বালানি ও বিনিয়োগ সম্পর্ক গভীর করেছে। ওপেক সমন্বয়ের বিষয়ে রাশিয়া ও ওয়াশিংটনের সঙ্গে তার মূল অংশীদারত্বের ওপরও অটল অবস্থায় রয়েছে।এই কৌশলগত বহুত্ববাদ মার্কিন নেতৃত্বের প্রত্যাখ্যান নয় বরং সৌদি আরবের উদীয়মান সংস্থার প্রতিফলন। ট্রাম্পের এই নমনীয় পদ্ধতিকে হুমকি হিসেবে দেখার পরিবর্তে গ্রহণ করা এবং বহুমেরু বিশ্বে জোট ব্যবস্থাপনার একটি বাস্তবসম্মত পুনঃসংজ্ঞাকে তুলে ধরেছে। যদিও তেলের মূল্য নির্ধারণ ও মুদ্রাপ্রবাহ অনেক পার্থক্য রয়ে গেছে। তার পরও সহযোগিতার নতুন কাঠামোর মধ্যে এগুলো পরিচালনা যোগ্য। এখন দুই দেশ আগের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, সন্ত্রাসবাদ দমন, সাইবার সহযোগিতা এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক পরিকনল্পনা নিশ্চিত করতে যৌথ নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। মার্কিন অবকাঠামো ও প্রযুক্তিতে সৌদি আরবের বিনিয়োগ আমেরিকান কর্মী ও শিল্পের জন্য বাস্তবসম্মত সুবিধা প্রদান করবে। অন্যদিকে আমেরিকানদের জ্ঞান ও প্রযুক্তি সৌদি আরবের তেল অর্থনীতির রূপান্তরকে ত্বরান্বিত করবে।ভবিষ্যতের দিকে তাকালে, রিয়াদ ওয়াশিংটনের কাছ থেকে কৌশলগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক ধারাবাহিকতা আশা করে। বিনিময়ে, তারা মূলধন, আঞ্চলিক নেতৃত্ব এবং নিরাপত্তা ও উদ্ভাবনের জন্য যৌথ প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।যদি এই গতিপথ বজায় থাকে, তাহলে ট্রাম্পের সফরকে উজ্জ্বল মুহূর্ত হিসেবে স্মরণ করা হবে। তবে গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ১৯ মাসের অভিযানে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনায় শুধু বহিষ্কার নয়, ইসরাইলকে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন অনেকে। যদিও ট্রাম্প প্রশাসন বলছে, তারা যুদ্ধবিরতির জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে অন্য কোনো দেশের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমালোচনা করলে তা হাস্যকর শোনায়। যুক্তরাষ্ট্রের এখন অন্য দেশকে তিরস্কার করার মতো নৈতিক অবস্থান, আইনি ভিত্তি বা বিশ্বাসযোগ্যতা-কোনোটিই নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সফরে মানবাধিকার বিষয়ে যতটা গুরুত্বের সাথে আলোচনা হওয়া উচিৎ, ট্রাম্পের সফরকালে বিষয়টি সেভাবে মনোযোগ পায়নি। তার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সৌদি আরব সফর সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের এক নির্ণায়ক ও কৌশলগত রূপান্তরের সূচনা করেছে যা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি ফলাফল এনেছে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |