![]() রাজনৈতিক বিভিক্তি বাংলাদেশের জন্য অশনিসংকেত হতে পারে
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() নীতিনির্ধারকেরা নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছেন না। তাঁদের উচিত, সঠিক জ্ঞানের আলোকে সমন্বয়ের চেষ্টা করা। বৈষম্য দূর করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল না হওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। পারিবারিক শিক্ষাকে জোর দিতে হবে। পরিবার থেকে বৈষম্যের সৃষ্টি হলে জাতীয় জীবনে এর প্রভাব পড়বে।অশান্তি ও অসহিষ্ণুতা দূর করার জন্য দায়িত্ব পালনকারীদের এগিয়ে আসতে হবে। মেধা ও যুক্তি দিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তাহলে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রগুলোর মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা অন্যতম। আমরা সবাই শান্তিতে থাকতে চাই। তবে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে অনেক সময় শান্তি বিনষ্ট হয়। সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুল তথ্য ছড়িয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করা হয়। এ থেকে মুক্তির জন্য সত্য ও মিথ্যা সম্পর্কে সঠিক জনমত সৃষ্টি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে বহু ধর্মের মানুষ বসবাস করে।প্রতিটি ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করবে; একে অন্যকে জানবে। এতে ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি হবে না। মানুষের শান্তি ও শৃঙ্খলার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও সহিষ্ণুতার চর্চা জরুরি। দীর্ঘ এ সময়ে দেশের নানান সংকটের উত্তরণ ঘটলেও সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহ ঠিক কতটা কেটে ওঠা সম্ভব, তা নিয়ে সত্যিই ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকার পরবর্তী ঘটনাক্রম ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে চললেও দেশের শিরদাঁড়ায় একধরনের পক্ষাঘাতের লক্ষণ ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সীমাহীন অনিয়ম, লুটপাট আর মানবিকতার অবনমনে সৃষ্ট শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি ক্ষোভ থেকে বিস্ফোরিত জনস্রোত বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার হাতছানি যখন দিচ্ছে,তখন দেশের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রতিহিংসার পারদ ঊর্ধ্বমুখী। ভঙ্গুর হয়ে গেছে সামাজিক কাঠামো। বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উপাদান জনগণের অভিপ্রায় বিভক্তির করাল গ্রাসে নিমজ্জিত। চারদিকে অস্থিরতা আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করে তুলছে যে আমাদের স্বাভাবিক চলাফেরা ও মতপ্রকাশের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে।কেন এমন হচ্ছে? যে দেশ রক্তের বিনিময়ে অর্জিত, যে দেশ রক্তের দামে দাম্ভিক কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে বিদায় জানায়, সেই দেশ কেন ঐক্যবদ্ধতার জাল না ছড়িয়ে অনৈক্যের পথে হাঁটছে? গত ৯ মাসের সামগ্রিক ঘটনাপ্রবাহ যারা অনুসরণ করছে, যারা সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে ভাবছে, তারা সমাজের বিভিক্তরেখাকে বাংলাদেশের সামনের দিনগুলোতে অশনিসংকেত হিসেবেই দেখবে বৈকি। ব্যাপারটি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রাষ্ট্রটি যে ভাবধারায় এত দিন লালিত হয়েছে, সেখানে ক্ষত দেখা দিয়েছে। চব্বিশের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সৃষ্ট সরকারের প্রতি মানুষের পাহাড়সম প্রত্যাশার জায়গা তৈরি হলেও গত ৯ মাসে তেমন কিছু দৃশ্যমান না হওয়ায় যেমন একদিকে ক্ষোভ বাড়ছে, তেমনি বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে হোঁচট খাচ্ছে বারবার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিতর্কের ধারাবাহিকতায় সরকারের ভেতর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে মনে হচ্ছে দুর্বল করে তুলছে। অন্যদিকে সীমান্তের অস্থিরতা আর ক্ষমতাচ্যুত রাজনৈতিক দলের নিষেধাজ্ঞার মারপ্যাঁচে মানবিক দৃঢ় রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে চিড় ধরার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথরেখায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীদের হাতে বৈষম্যময় হয়ে ওঠায় সাধারণ মানুষের রক্তস্নাত রাজপথ বারবার তৈরি হয়েছে। অথচ এবারের চব্বিশের প্রত্যাশাটি অন্য রকম ছিল। আশা ছিল, অতীতের সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে উদার দৃষ্টিভঙ্গির দেশ আমরা গড়ব। অপরাধীরা শাস্তির কাতারে আসবে, সবার মতামতের মূল্যায়ন ঘটবে। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, প্রতিহিংসার আগুন আমাদের খেয়ে ফেলছে। দেড় যুগের দমন পীড়নের প্রতিশোধ নেওয়ায় ব্যস্ত শক্তিগুলোর ফাঁদে পা দিয়েছে সরকার। অতীতের সরকারের সুবিধাভোগীদের মতো লুটপাট আর চাঁদাবাজির খপ্পরে পড়েছে দেশ। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব হওয়া থেকে শুরু করে জনমনে ভীতির আবাসন বেশ পোক্ত হয়ে যাচ্ছে। সরকারের কিছু অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে বহিঃশক্তির জন্য নানামুখী উচ্চাশা যেমন তৈরি করেছে, তেমনি আমাদের দেশের ভেতরে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর দীর্ঘমেয়াদি শৃঙ্খলায় একধরনের ফাটল আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। গত ৯ মাস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দেশের ভেতর একদল মানুষ নারীশক্তি, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অঘোষিত সংস্কারবাজি করে ফেলছে। খেয়ালখুশিমতো দেশের শাসনব্যবস্থা তৈরির স্বপ্ন দেখছে তারা। ফলে আগামীর বাংলাদেশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঠিক কেমন হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে সবার মনে উৎকণ্ঠার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে নিশ্চিত থাকুন, দেশটা থমকে যাবে কিংবা পিছিয়ে পড়বে। একটি দেশের জন্মের ৫৪ বছর পরও যখন একটি পক্ষ আর একটি পক্ষকে ঘায়েল করায় ব্যস্ত, তখন সমাজের শান্তি অনলে পরিণত হবে। আমরা এমন পরিস্থিতি দেখতে চাই না। এমনিতে এ দেশটা শোষণের কড়াল গ্রাসে ক্ষতিগ্রস্ত, বিশ্বদরবারে শিক্ষা ও গবেষণায় যোজন যোজন দূরত্বে, সেখানে কূপমণ্ডূকতার মোড়কে ঢেকে গণতান্ত্রিক উত্তরণ সম্ভবপর হবে না। ভীতি কিংবা ঘৃণা ছড়িয়ে শক্তিশালী মতের রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়। আসুন আমরা প্রতিহিংসার বলয় থেকে বের হয়ে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ সমাজব্যবস্থা বিনির্মাণে এগিয়ে আসি। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার শক্ত সমর্থক। তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তাঁর প্রতিশ্রুতি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাঁর সবচেয়ে বাস্তব অঙ্গীকার। কারণ, এটিই তাঁর সবচেয়ে বাস্তবায়ন যোগ্য লক্ষ্য।তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন,২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হতে পারে। যদিও এই লক্ষ্য এখনো সুনির্দিষ্টভাবে চূড়ান্ত হয়নি এবং দেশকে নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্পষ্টভাবে একটি পথরেখা তৈরি করা হয়নি। তবে সামনে এমন কিছু জটিলতা ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ তৈরি কঠিন করে তুলতে পারে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তিসংগতভাবে বলছেন, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত রাজনৈতিক অপশাসনের অবস্থা যদি স্থায়ী হয়, তবে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করেও খুব একটা লাভ হবে না। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। এর মধ্য দিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বিএনপির দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি আস্থাহীনতার বিষয়টিই উঠে এসেছে যে তারা কাঠামোগত সংস্কারের প্রতি আদৌ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কি না।অধ্যাপক ইউনূস ও শিক্ষার্থীরা প্রকৃত প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার চান, যা সত্যিকারের পরিবর্তন আনতে পারে। সৌভাগ্যবশত পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে সেই আশা বাদ দেওয়ার মতো নয়। বাংলাদেশ আজ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে। তিনি সর্বজন-সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, যাঁর সততা প্রশ্নাতীত। সীমান্তের ওপার থেকে তাঁকে ক্ষমতালোভী, অসহিষ্ণু ও কট্টরপন্থী হিসেবে চিত্রিত করার যে চেষ্টা চলছে, তাতে বিশ্বাস যোগ্যতার ঘাটতি রয়েছে এবং এর উদ্দেশ্য পক্ষপাতমূলক বলে মনে হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর উপস্থিতি দেশকে এক বিরল মুহূর্ত এনে দিয়েছে, যেখানে শাসনব্যবস্থা পরিচালনা ও নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হচ্ছে মূলত ব্যক্তিস্বার্থে নয়; বরং সবার ভালোর জন্য। এসব সিদ্ধান্তের কোনো কোনোটিতে বিচক্ষণতার ঘাটতি থাকতে পারে, শাসনব্যবস্থা পরিচালনার কিছু ক্ষেত্রে ত্রুটি হয়ে থাকতে পারে; কিন্তু এই সরকারের অঙ্গীকার এখনো আন্তরিক। যদি এ ধরনের শাসনব্যবস্থা বাস্তবসম্মত পরিবর্তনের পথ দেখাতে না পারে, তবে বাংলাদেশ নিশ্চিতভাবে হতাশা ও অসন্তোষের আরেক যুগের মুখোমুখি হতে পারে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |