![]() রাজনীতির ফাঁদ থেকে পুলিশকে মুক্ত করা কতদূর সম্ভব?
মীর আব্দুল আলীম:
|
![]() স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে পুলিশ কখনও ছিল রাষ্ট্রের নিরাপত্তার প্রহরী, আবার কখনও পরিণত হয়েছে শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক লাঠিয়ালে। শাসকের টিকে থাকার অস্ত্র হিসেবে বারবার ব্যবহৃত হয়েছে গ্রেপ্তারি অভিযান, ভীতিকর হুলিয়া, নিখোঁজের ঘটনা আর ভয়াবহ নির্যাতন। বছরের পর বছর ধরে একের পর এক সরকার প্রশাসনের পেশাদার চরিত্রকে নতজানু করে গড়ে তুলেছে এক ধরনের আনুগত্যের সংস্কৃতি। ফলে নতুন প্রশাসনিক রদবদল সহজ হলেও, মাঠপর্যায়ের মনস্তাত্ত্বিক সংস্কার হয়ে ওঠে প্রায় অসম্ভব এক চ্যালেঞ্জ। ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থাকা সাধারণ জনগণ আজও পুলিশের ভেতরে এক ‘সতর্ক ভয়’ বয়ে বেড়ায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গায়েবি মামলা এক গভীর রাজনৈতিক অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিরোধী দলের আন্দোলন দমনে হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় এসব মামলা। অভিযোগের সত্যতা যাচাই ছাড়াই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়, চার্জশিট তৈরি হয় শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছা অনুযায়ী। এসব মামলার কারণে একদিকে বিরোধী রাজনীতির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ আইনের প্রতি আস্থা হারায়। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু মামলা প্রত্যাহার শুরু হলেও এসব হচ্ছে নির্বাচনী বা আন্তর্জাতিক চাপে নেওয়া কৌশলী পদক্ষেপ। সার্বিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও বিচারিক নিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠা না হলে এই অপপ্রয়োগের সংস্কৃতি অটুট থেকে যাবে। বাংলাদেশে থানায় গিয়ে সাধারণ মানুষকে এখনও নানামুখী বিড়ম্বনার মুখে পড়তে হয়। মামলা নিতে গড়িমসি করা, অভিযোগকারীকে নানা অজুহাতে হয়রানি, ঘুষ দাবি, দালালদের দৌরাত্ম্য — এসব যেন থানার স্বাভাবিক চিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক থানায় কমিউনিটি পুলিশিং, নারী-শিশু সহায়তা ডেস্কের মতো প্রকল্প চালু থাকলেও সেগুলো প্রায়ই কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকে। এই পরিস্থিতি জনগণের মধ্যে পুলিশের প্রতি ভয় ও অনাস্থা তৈরি করে। অথচ পেশাদার পুলিশিং মানে শুধু প্রশিক্ষণ নয়; প্রয়োজন মানুষের প্রতি সহমর্মিতা, সহানুভূতি ও সমস্যা বুঝে সেবা প্রদানের মানসিকতা। পুলিশকে আইনের সেবক হিসেবে নিজেদের অবস্থান মজবুত করতে হলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিশ্বাসভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ব্যক্তিগতভাবে সৎ ও পেশাদার থাকতে চাইলেও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ তাদের সেই চেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করে। থানায় সাধারণ একটি জিডি নথিভুক্ত করা থেকে শুরু করে বড় কোনো অপরাধে পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও দলীয় প্রভাবের ছায়া পড়ে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাদের ফোন বা মৌখিক নির্দেশ অনেক সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গাটুকু কেড়ে নেয়। এতে পুলিশ আইনের প্রয়োগের বদলে রাজনৈতিক ইচ্ছার বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হয়। ফলে মাঠ প্রশাসনে এক ধরনের দোটানা তৈরি হয়— তারা আইনের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে, নাকি রাজনৈতিক নির্দেশ মানবে? এই দ্বন্দ্ব পুলিশ বাহিনীর পেশাদারিত্বে চিড় ধরায় এবং জনবিশ্বাসেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন এলেই পুলিশের ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে ওঠে। বিরোধী দলের প্রার্থীদের গ্রেপ্তার, কর্মীদের হয়রানি, এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখানো, এমনকি ভোটের আগের রাতেই ভোটকেন্দ্র দখলের অভিযোগ— এসব দৃশ্য বারবার ফিরে আসে। ফলে শুধু বিরোধী দল নয়, সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে সন্দেহ ও হতাশা জন্মায়। নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা দুর্বল হলে গণতন্ত্রের ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে পড়ে। পুলিশ যদি রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রেখে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারে, তবে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা সর্বদাই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ পুলিশের মধ্যে পদোন্নতি, বদলি ও পদায়নে প্রায়ই পেশাদার দক্ষতার চেয়ে রাজনৈতিক আনুগত্য বড় হয়ে ওঠে। অনেক মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা শুধু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে কাঙ্ক্ষিত পদে পৌঁছাতে পারেন না। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠতার সুবাদে অনেকে দ্রুত উন্নতি লাভ করেন। এর ফলে বাহিনীর মধ্যে বৈষম্য, হতাশা এবং পেশাগত নিষ্ঠায় ভাঙন সৃষ্টি হয়। দীর্ঘমেয়াদে এটি পুরো বাহিনীর দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন করে। পুলিশের পেশাদার কাঠামো গড়ে তুলতে হলে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতির সংস্কৃতি চালু করা জরুরি। গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা শুধু দেশের ভেতরেই নয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত করে চলেছে। জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা বারবার এসব ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বেশ কয়েকটি দেশের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করা হয়েছে। এর ফলে শুধু রাজনৈতিক সম্পর্ক নয়, বাণিজ্যিক সহযোগিতার ক্ষেত্রেও অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মার্কিন ভিসানীতি বা জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালের প্রশ্নেও এই ইস্যুগুলো বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু সংস্কারমূলক উদ্যোগ দেখা গেছে, তবে মূল সমস্যা থেকে যাচ্ছে দায়মুক্তির সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি ভেঙে দিতে হলে প্রয়োজন স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষীদের কঠোর শাস্তি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত বিচারিক প্রক্রিয়া। তবেই দেশি-বিদেশি আস্থা কিছুটা হলেও পুনর্গঠিত হতে পারে। বর্তমানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিস্তৃত প্রভাবের ফলে পুলিশের যেকোনো অনিয়ম বা বাড়াবাড়ির ঘটনা মুহূর্তেই জনসমক্ষে চলে আসে। একটি ভিডিও ক্লিপ, একটি অডিও রেকর্ডিং কিংবা একজন প্রত্যক্ষদর্শীর ফেসবুক পোস্ট রাতারাতি ভাইরাল হয়ে দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নেয়। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য আগের মতো দায়মুক্তির সুযোগ আর আগের জায়গায় নেই। বিশেষ করে মোবাইল প্রযুক্তি, সিটিজেন জার্নালিজম ও লাইভ ব্রডকাস্টের যুগে পুলিশের প্রতিটি পদক্ষেপ নজরদারির আওতায় চলে এসেছে। এই নতুন বাস্তবতা পুলিশকে যেমন বাড়তি চাপের মুখে ফেলেছে, তেমনি তাদের জন্য পেশাদারিত্ব, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সংস্কৃতি গড়ে তোলার সুযোগও এনে দিয়েছে। এখন পুলিশ বাহিনীর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে — জনগণের আস্থা অর্জন করা। আস্থা অর্জনের একমাত্র উপায় হচ্ছে আইনের শাসনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা এবং মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। বাংলাদেশ পুলিশের অভ্যন্তরে বর্তমানে দুটি স্পষ্ট ধারা গড়ে উঠেছে। একদিকে রয়েছেন পেশাদার, যোগ্য ও নীতিনিষ্ঠ কর্মকর্তারা, যারা আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আদর্শে বিশ্বাসী। অন্যদিকে রয়েছে একটি সুবিধাবাদী অংশ, যারা রাজনৈতিক আনুগত্যের বদৌলতে পদোন্নতি, পদায়ন ও প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ গ্রহণ করছে। এই গোষ্ঠীটি অনেক সময় আইনের তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফলে বাহিনীর অভ্যন্তরে তৈরি হয়েছে নৈতিক সংকট এবং আস্থার সংকট। অনেক মেধাবী ও সৎ কর্মকর্তা নিজেদের কোণঠাসা বোধ করেন, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধা তৈরি হয়। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব বাহিনীর ঐক্যকেই শুধু নয়, ভবিষ্যৎ পেশাগত কাঠামোকেও দুর্বল করছে। রাষ্ট্রযন্ত্রের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য এই বিভাজন দ্রুত নিরসন করা জরুরি। অন্যথায় বাহিনীর পেশাদারিত্বের ভিত্তি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ পুলিশের অনেক কার্যপ্রণালী এখনও চলে ব্রিটিশ আমলের ১৮৬১ সালের পুলিশ আইনের ছকে। আধুনিক রাষ্ট্রের চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে স্বাধীন পুলিশ কমিশন, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, স্বাধীন তদন্ত ইউনিট, স্বতন্ত্র অভ্যন্তরীণ অডিট সেল গঠনের উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে। অথচ এসব সংস্কারের জন্য আইন সংশোধনের উদ্যোগ এলেও রাজনৈতিক চাপ ও সুবিধাবাদের কারণে তা আটকে থাকে। পুলিশ সংস্কারের প্রধান শর্ত হলো রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যারা পুলিশকে দলীয় বাহিনীতে রূপান্তর করে, তারাই আবার বিরোধী দলে গেলে পুলিশের নিরপেক্ষতার দাবি তোলে। এই দ্বিচারিতা সংস্কারকে বাধাগ্রস্ত করে। অন্তর্বর্তী সরকারের সীমিত সময়ের চেষ্টা প্রশংসিত হলেও স্থায়ী সংস্কার আনতে হলে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী উভয় পক্ষকেই বড় মনের পরিচয় দিতে হবে। সবচেয়ে বড় বাধা থেকে যায় রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিতে। যখনই কোনো দল ক্ষমতায় আসে, তারা চায় পুলিশ তার পক্ষেই থাকুক। অন্তর্বর্তী সরকার কিছুটা আলাদা চিন্তা এনেছে বটে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার আনতে হলে সব রাজনৈতিক পক্ষের সম্মিলিত সদিচ্ছা দরকার। এই মনোভাবের পরিবর্তন না হলে যে কোনো সময় আবারও পুরনো ধারা ফিরে আসতে পারে। সব হতাশার মাঝেও আশার আলো একেবারে নিভে যায়নি। তরুণ অনেক পুলিশ কর্মকর্তা সৎভাবে দায়িত্ব পালন করছেন, পেশাদারিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছেন। নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন, সাংবাদিকতা — এসব চাপও ধীরে ধীরে একটি সংস্কারমুখী গণআন্দোলনের রূপ নিচ্ছে। এই লড়াই দীর্ঘ, কিন্তু প্রয়োজন অটল অবস্থান ও সত্যিকারের পরিবর্তনের ইচ্ছা। বাংলাদেশের পুলিশের সামনে এখন এক কঠিন সন্ধিক্ষণ। হয় তারা পুরনো রুটিনে ফিরে যাবে, নতুবা সাহস করে নতুন এক পেশাদার অধ্যায় শুরু করবে। প্রশাসনিক সংস্কার, শক্তিশালী জবাবদিহি, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি আর বাহিনীর ভেতরের নৈতিক শক্তি — এই চার উপাদানই ঠিক করে দেবে পুলিশের আগামী পথচলা। যদি এই পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়, তবে শুধু পুলিশ নয়, গোটা বাংলাদেশের গণতন্ত্রই পাবে এক নতুন শক্ত ভিত। সব দুঃসময়ের মধ্যেও আশার আলো আছে। নতুন প্রজন্মের অনেক পুলিশ কর্মকর্তা নৈতিকতা, আইনের শাসন ও পেশাদারিত্বের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। তারা চাপের মধ্যেও দায়িত্ব পালন করছেন। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপও সংস্কারের গতিকে সচল রাখছে। প্রয়োজন শুধু সমন্বিত এক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ইচ্ছাশক্তি। বাংলাদেশ পুলিশের বর্তমান বাস্তবতা এক দ্বিধার মধ্যে দাঁড়িয়ে। হয় তারা পুরনো লুটেরা সংস্কৃতির ধারায় ফিরে যাবে, নয়তো সাহস করে এক নতুন পেশাদার অধ্যায় শুরু করবে। শক্তিশালী জবাবদিহির কাঠামো, স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার পরিবেশ, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি আর অভ্যন্তরীণ নৈতিক শক্তিই ঠিক করে দেবে পুলিশের ভবিষ্যৎ পথচলা। এই যাত্রা সফল হলে বাংলাদেশের গণতন্ত্রও পাবে এক দৃঢ় ভিত্তি; আইনের শাসন হবে বাস্তবতা, কেবল স্লোগান নয়। মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। |