![]() ট্রাম্প-মাস্কের মধুচন্দ্রিমায় বিচ্ছেদের ছায়া
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() এখন প্রশ্ন হলো-বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ট্রাম্প ও সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি মাস্কের বন্ধুত্বে কীভাবে ফাটল ধরল? এখন এর পরিণতি কী হতে পারে? এটাই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শেষ।তিনি আর সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চান না। মাস্কের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করতে চান কী না? এমন প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প স্পষ্টভাবে না বলে দেন। এই মন্তব্য সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে মাস্কের সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্য বিরোধের সর্বশেষ বহিঃপ্রকাশ। টেসলা ও স্পেসএক্সের সিইও মাস্ক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচারে কোটি ডলার অনুদান দিয়েছিলেন। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তিনি হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি তিনি ট্রাম্পের কর ও ব্যয় বিলের কঠোর সমালোচনা করেন বলেই নাকি এই বিচ্ছেদ। সম্প্রতি ট্রাম্পের কর ও ব্যয় বিলকে জঘন্য বলে কটাক্ষ করেন মাস্ক। মাস্ককে নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাম্প বলেন, ‘আমি ভীষণ হতাশ। কারণ, এখানে উপস্থিত অন্য যে কারও চেয়ে তিনি এ বিলের ভেতরের খুঁটিনাটি সম্পর্কে ভালো জানতেন। হঠাৎই এটি নিয়ে তাঁর সমস্যা শুরু হয়েছে।’ তবে ট্রাম্পের এ দাবিকে মিথ্যা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন মাস্ক। ধনকুবের ইলন মাস্কের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে থাকা সব সরকারি চুক্তি বাতিল করার হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।এদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন হুমকির জবাবে মাস্ক বলেছেন, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের একসময়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এখন যেন প্রকাশ্য রণক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে। আলোচিত কর ও ব্যয়-সংক্রান্ত বাজেট বিল নিয়ে মতবিরোধকে কেন্দ্র করে কিছুদিন ধরেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইলন মাস্কের মধ্যকার সম্পর্কে টানাপোড়েন চলছিল। এবার প্রকাশ্যে পাল্টাপাল্টি আক্রমণাত্মক মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্কে ফাটল ধরল। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বসে টেসলার সিইও ইলন মাস্ককে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপরই মূলত এ প্রকাশ্য বৈরিতার সূচনা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি আর সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তির একসময়কার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সবার চোখের সামনে ভেঙে পড়ে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমাদের বাজেটে অর্থ সাশ্রয়ের সবচেয়ে সহজ উপায় হলো ইলন মাস্কের সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তিগুলো বাতিল করা, যা শত শত কোটি ডলার বাঁচাতে পারে।’ ট্রাম্পের এ কথার জবাবে এক্সে একটি পোস্ট দেন ইলন মাস্ক। সেখানে তিনি লেখেন, হ্যাঁ, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসনের প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত। তবে বাস্তবতা হলো, কংগ্রেসের দুই কক্ষেই রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় ট্রাম্পকে অভিশংসনের আশঙ্কা খুবই কম। এর আগে মাস্কের সমালোচনা করে ট্রাম্প বলেন, টেসলার সিইওর ওপর তিনি ভীষণ হতাশ। ট্রাম্পের এ মন্তব্যের পর চুপ করে বসে থাকেননি মাস্ক। সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ কথার জবাব দেন তিনি। এদিকে ট্রাম্প ও মাস্কের এমন পাল্টাপাল্টি বক্তব্যের পর টেসলার শেয়ারদর ব্যাপক হারে কমে গেছে। ট্রাম্পের এ বক্তব্য যখন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার হচ্ছিল, ঠিক তখনই ইলন মাস্ক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লাইভ টুইট করে প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, তাঁর সহায়তা ছাড়া ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্প জিততে পারতেন না। ট্রাম্পকে অকৃতজ্ঞ বলেও কড়া সমালোচনা করেন মাস্ক। ট্রাম্প ও মাস্কের বাগ্যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস আগেও তাঁদের অবিচ্ছেদ্য রাজনৈতিক শক্তি মনে করা হতো। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে দ্বিতীয় মেয়াদে জেতাতে প্রায় ২০ কোটি ডলার খরচ করেছিলেন মাস্ক। ট্রাম্পও তাঁর প্রশাসনে মাস্ককে যুক্ত করে নেন। সরকারি ব্যয়ে কাটছাঁট করতে নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) দায়িত্ব পান মাস্ক। নতুন এই প্রতিষ্ঠানের (ডিওজিই) নামটিও ধনকুবের মাস্কের পছন্দের একটি ইন্টারনেট মিম থেকে নেওয়া বলে মনে করা হয়। ২০২০ সালের দিকে কুকুরের এই মিম বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের একেবারে শুরুর সপ্তাহগুলোয় তাঁর বন্ধু মাস্ককে প্রশাসনের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিবেচনা করা হচ্ছিল। এ নিয়ে জনগণের মধ্য থেকে সমালোচনাও কম হয়নি। মাস্কের নেতৃত্বাধীন ডিওজিই ফেডারেল সরকারের হাজার হাজার কর্মীকে বরখাস্ত করে। বন্ধ করা হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার জন্য মার্কিন সরকারের প্রতিষ্ঠান ইউএসএআইডিও রয়েছে। ওই সময় মাস্ক এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছিলেন যে ডেমোক্র্যাটদের অনেকেই তাঁকে প্রেসিডেন্ট ইলন বলে ডাকতে শুরু করেন। তখন ট্রাম্প ও মাস্ক ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে গেছেন। নিজেদের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ফক্স নিউজকে পাশাপাশি বসে সাক্ষাৎকার দেন ট্রাম্প ও মাস্ক। একে অপরকে প্রশংসা করেন তাঁরা। মাস্কের প্রশংসা করে ট্রাম্প বলেছিলেন,‘তিনি একজন নেতা'। প্রত্যুত্তরে মাস্ক বলেছিলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্টকে ভালোবাসি। আজ এটা স্পষ্ট করে দিতে চাই।’ দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মাস্ক কয়েক বছর ধরে ডানপন্থী মনোভাব পোষণ করতে শুরু করেন। এ সময় থেকে তিনি ডেমোক্র্যাট ও প্রগতিশীলদের সমালোচনা করতেও শুরু করেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটার কিনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে মাস্কের এমন মনোভাব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি টুইটারের নাম বদলে ‘এক্স’ রাখেন। মাস্ক অনিয়মিত অভিবাসনের বিরোধিতা ও বাক্স্বাধীনতার ওপর নজরদারির প্রচেষ্টা হিসেবে এক্সকে ব্যবহার করতে শুরু করেন।বিশেষ করে পরিচয়ের রাজনীতি ও করোনা মহামারির সময় এটা প্রকটভাবে দেখা যায়। মাস্ক রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে একসময় ট্রাম্পের সমালোচনাও করেছেন। এক্সে লিখেছিলেন, কোনো প্রতিষ্ঠানের সিইও হওয়ার জন্য ট্রাম্প বেশ বয়সী একজন ব্যক্তি। এমনকি দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যও। ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতার লড়াইয়ে ট্রাম্পের রিপাবলিকান প্রতিপক্ষ রন ডিস্যান্টিসকে প্রাথমিক সমর্থন দিয়েছিলেন মাস্ক। এমনকি ফ্লোরিডার গভর্নর নির্বাচনের প্রচারেও রনের সমর্থনে এক্সে পোস্ট দিয়েছেন মাস্ক। পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী প্রচারের সময় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্পের ওপর হামলা হয়। প্রাণে বেঁচে যান ট্রাম্প। তখন মত বদলান মাস্ক। জানান, তিনি রিপাবলিকান প্রার্থী ট্রাম্পকে পূর্ণ সমর্থন দেবেন। পরে ট্রাম্পের প্রচার সভায় হাজির হন মাস্ক। এভাবেই প্রকাশ্যে শুরু হয় ট্রাম্প ও মাস্কের বন্ধুত্ব। এর পরের ঘটনা সবার জানা। ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হলে তিনি সরাসরি প্রশাসনে যুক্ত করে নেন মাস্ককে। তবে গত এপ্রিলে মাস্ক জানান, তিনি ডিওজিইতে কম সময় দেবেন। আর মে মাসে এসে মাস্ক ট্রাম্প প্রশাসনের কর ও ব্যয় প্রস্তাবনা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন।ডিওজিই প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন ইলন মাস্ক। তাঁর বিদায় উপলক্ষে ওভাল অফিসে একটি জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজনও করেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু এর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মাথায় কর ও ব্যয়সংক্রান্ত বাজেট বিলকে কেন্দ্র করে দুজনের সম্পর্কে ফাটল দেখা দিয়েছে।অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ফৌজদারি অভিযোগসহ সাধারণ মানুষের কাছে কেলেঙ্কারি থেকে বেঁচে থাকার রেকর্ড রয়েছে। তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহারের স্পষ্ট ইচ্ছাও দেখিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁর ডেমোক্রেটিক পূর্বসূরি জো বাইডেনের প্রশাসনের কর্মকাণ্ডের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এরই মধ্যে মহাকাশবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স, যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান স্টারলিংকসহ মাস্কের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্ভাব্য ঝুঁকির বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন ট্রাম্প। তিনি লিখেছেন, বাজেটে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থ সাশ্রয় করার সবচেয়ে সহজ উপায় ইলনের প্রতিষ্ঠান গুলোর সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি বাতিল করা। মাস্কও পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষেক ভাষণে ট্রাম্প তাঁর একটি ইচ্ছার কথা জানান। তিনি বলেন, মঙ্গল গ্রহের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা দেখার অভিপ্রায় রয়েছে তাঁর। কিন্তু মাস্ক বলেছেন, আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে পৌঁছানোর জন্য স্পেসএক্সের রকেট ব্যবহারের যে উদ্যোগ যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, তিনি তা বাতিল করার পরিকল্পনা করছেন। মার্কিন সিনেটে ট্রাম্পের সই করা কর ও ব্যয় বিল আটকে দিতে আর্থিক খাতের রক্ষণশীল আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে জোট বাঁধতে পারেন মাস্ক। মাস্কের মন্তব্যে ট্রাম্পের বিল নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যকার মতবিরোধকেই প্রতিফলিত করছে। প্রতিনিধি পরিষদে বিলটি নিয়ে আলোচনা চলার সময় প্রতিনিধি পরিষদের রিপাবলিকান সদস্যদের বিভিন্ন অংশ এর বিরোধিতা করেছিল। প্রতিনিধি পরিষদে পাস হওয়ার পর এখন রিপাবলিকান-নিয়ন্ত্রিত সিনেটেও এই বিল নিয়ে আলোচনা চলছে। সেখানেও বিলটি নিয়ে মতবিরোধ দেখা গেছে। ট্রাম্প ও মাস্কের বন্ধুত্বের টানাপোড়েনে এখন কী হতে পারে, সেটা স্পষ্ট নয়। রিপাবলিকানদের মধ্যে মাস্ক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। যদিও তাঁর রাজনৈতিক উত্থান অনেকটাই ট্রাম্পের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত ধরে। কিন্তু এখন তিনি ডেমোক্র্যাট আর ট্রাম্পের অনুগত-উভয় পক্ষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে যেতে পারেন। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |