![]() দেশের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার জরুরি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() শিক্ষকদের প্রধান দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মকে সঠিক শিক্ষা প্রদান এবং তাদের মাঝে কল্যাণমুখী জীবন গঠন ও পরিচালনার জন্য মূল্যবোধ গড়ে তোলা, যাতে তারা নিজস্ব মেধায় অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তাই শিক্ষা নামক জাতির মেরুদণ্ডকে সচল ও শক্তিশালী রাখা এবং জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম। শিক্ষকরাজনীতির পেছনে যত সব কারণই থাকুক না কেন, এটি শিক্ষার মতো সম্মানজনক পেশার ক্ষেত্রে গভীর উদ্বেগ ও হতাশার জন্ম দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হয়ে ওঠার বদলে শিক্ষকরা হয়ে উঠছেন নৈতিক অধঃপতন, বৈষম্য ও বিভাজনের মূর্ত প্রতীক। ফলে শিক্ষকরাজনীতি শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকেই বাধাগ্রস্ত করেনি, বরং সমাজ, সংস্কৃতি ও শিক্ষাব্যবস্থার জন্য একটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায়ই রাজনৈতিক প্রভাবের শিকার হয়েছে, যা শিক্ষার গুণগত মান ও উদ্দেশ্যকে ক্ষুণ্ন করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিবর্তন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রতিটি সরকারই তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্য অনুযায়ী শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছে। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে, যা শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি সুশিক্ষিত, সচেতন ও উদারনৈতিক প্রজন্ম গঠনকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বিভিন্ন সময়ে পাঠ্যক্রমে পরিবর্তন আনা হয়েছে, যেখানে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক আদর্শ বা দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সংকীর্ণ ও একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রভাব শুধু পাঠ্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায়ও এর প্রভাব সুস্পষ্ট। আমাদের দেশে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে প্রায়ই মেধার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনা একটি বড় ভূমিকা পালন করে। যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক আনুগত্য বা পরিচয় অনেক সময় নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হচ্ছেন, যা শিক্ষার গুণগত মানকে ব্যাহত করছে। শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা ছিল, জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন ইতিবাচক পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজি বন্ধ হবে। কিন্তু অভ্যুত্থানের প্রায় নয় মাস পেরিয়ে গেলেও তা বন্ধ হয়নি এবং স্থিতিশীলতাও ফেরেনি। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে নেয়া হয়নি কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগও। প্রায় নয় মাস আগে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হয়েছে। এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় স্থিতিশীলতা ফেরেনি। এখনো অব্যাহত রয়েছে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজির মতো ঘটনা। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংগঠনের রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের একটি অংশ এসব অপকর্মে জড়িত বলে অভিযোগ। ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোয় আগের মতোই অস্থিরতা রয়েছে। দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় চলমান দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও অনিয়মের চিত্র অত্যন্ত উদ্বেগজনক। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে যে, প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা-সর্বত্র দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা জেঁকে বসেছে। শিক্ষা খাতে অনিয়ম, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি শুধু সরকারের অর্থেরই অপচয় হচ্ছে না, বরং শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়াচ্ছে; বিঘ্নিত হচ্ছে প্রকৃত জ্ঞানার্জন ও শিক্ষা কার্যক্রম। সর্বোপরি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। মানবসম্পদ সৃষ্টিতে শিক্ষার বিকল্প নেই এবং এ পর্যন্ত বিকল্প কোনো পন্থাও আবিষ্কৃত হয়নি। তাহলে শিক্ষা দাঁড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে। একটি আধুনিক রাষ্ট্রে শিক্ষার কী ভূমিকা, তা অবশ্যই আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে যদি রাষ্ট্রের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা শিক্ষা খাতে ধস নামে, তাহলে এটি জাতির জন্য বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দেবে। বিগত সরকারের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক দলীয় রাজনীতি প্রকট হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি আরো বেশি কলুষিত হয়েছে। শিক্ষক নিয়োগেও রয়েছে অনিয়ম। শিক্ষক নিয়োগে দলীয় পদ-পদবি ও আঞ্চলিক প্রীতিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, মেধা ও গবেষণাকে অবহেলা করা হয়েছে। এ কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পঙ্গু হওয়ার পথে। গত আগস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর প্রায় সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই অভিভাবকহীন হয়ে গিয়েছিল। উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ—সবাইকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। এ থেকেই বোঝা যায়, নিয়োগের ক্ষেত্রে কেমন রাজনৈতিক দলীয়করণ হয়েছে যে সরকার পরিবর্তনের ফলে সবাইকে চলে যেতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও শিক্ষার মান বজায় রাখতে হলে শিক্ষক নিয়োগে মেধার মূল্যায়ন করতে হবে, দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান- গুলোয় অনিয়ম, দুর্নীতি ও টেন্ডারবাজি বন্ধে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, নিরপেক্ষ নিয়োগ ব্যবস্থা চালু, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলতে হবে। শুধু মুখে দুর্নীতিবিরোধী কথা না বলে সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে যদি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে সুফল পাওয়া যাবে। তবে এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে এমন আইন প্রণয়ন করতে হবে, যাতে তারা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে।শিক্ষায় রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতি শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি জাতির ভবিষ্যৎও ধ্বংস করছে।শিক্ষার্থীরা যদি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অভাবে বড় হয়, তাহলে তারা সমাজে দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠবে। এটি জাতির জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। শুধু আইন প্রণয়ন নয়, তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষায় দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর হলে তা জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তাই শিক্ষায় অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে হলে সরকারের উচিত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখব সেখানে উচ্চ শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছে, গবেষণা ও নতুন জ্ঞান উৎপাদন বেড়েছে। বহু নতুন জ্ঞানের সংযোজন হয়েছে;সমৃদ্ধ হয়েছে বিশ্ব জ্ঞানভাণ্ডার। এছাড়া উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক প্রভাব থাকে না বললেই চলে। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় থাকে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় দীর্ঘদিন ধরেই দুর্নীতি,টেন্ডারবাজি ও অনিয়ম বিরাজমান, যা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়েও বন্ধ হয়নি। অনেকেই প্রত্যাশা করেছিলেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় গুণগত পরিবর্তন হবে এবং স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে। কিন্তু তা হয়নি। পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ে অপচয়, রাজনৈতিক প্রভাব, টেন্ডারে অনিয়ম ও ছাত্ররাজনীতির নামে চাঁদাবাজি এখনো চলমান। সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতির শিকড় গভীর হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষায় ঘুস, চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক প্রভাব বন্ধ না হলে অর্থাৎ মানসম্পন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা না গেলে সব ধরনের সংস্কার ও অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে পড়বে। সরকারের উচিত, শিক্ষাকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রেখে কঠোর ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। শিক্ষার শক্তি বাড়াতে ভালো একটি বই জাগ্রত শিক্ষকের মতো কাজ করে। আতশ কাচ যেমন সূর্যের সাধারণ রশ্মিকে বহু গুণ বাড়িয়ে কাগজে আগুন ধরাতে পারে, তেমনি প্রকৃত শিক্ষার শক্তি মেধাকে প্রজ্বালনের মাধ্যমে জাতিকে করতে পারে নিরাপদ, প্রজ্ঞাময় ও সমৃদ্ধিশালী। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |