![]() মধ্যপ্রাচ্যের সাথে কাঁপছে বিশ্ব : যুদ্ধ কি সীমা ছাড়াবে?
মীর আব্দুল আলীম:
|
![]() সিরিয়া উত্তাল। লেবানন অস্থির। সৌদি চুপচাপ, কিন্তু ব্যস্ত। আমেরিকা? তারা এখনও বিশ্বপুলিশ! যুদ্ধ কি শুধু গাজা আর ইরানে থামবে? না কি এবার ছড়াবে পুরো অঞ্চলে? অথবা আরও ভয়ানক কিছু? পরমাণু? এই বিশ্লেষণে থাকছে নানা দিক। প্রতিটা খোলসা করবে যুদ্ধের গতি ও রাজনীতির কৌশল। একটু থেমে ভাবার জায়গা তৈরি করবে। বিশ্ব যাচ্ছে কোথায়? আর শান্তি কতদূর? নেতানিয়াহুর আগ্রাসন রাজনীতি: ইসরায়েলের বর্তমান সরকার উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। গাজা, পশ্চিম তীর এবং লেবানন সীমান্তে যেভাবে সামরিক আগ্রাসন চলছে, তাতে বোঝা যায়—সামরিক শক্তিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন নেতানিয়াহু। তাঁর সরকারের জনপ্রিয়তা যখন কমে যায়, তখনই যুদ্ধকে সামনে নিয়ে এসে দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো হয়। ফিলিস্তিনে বেসামরিক লোকজনের ওপর অতর্কিত হামলা, অবরোধ, ভূমি দখল এবং সামরিক অভিযানের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন ইসরায়েলের নীতিগত দিককে চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। তাঁর নেতৃত্বে দেশটি প্রায় একটি মিলিটারি থিওক্রেসিতে রূপ নিয়েছে, যেখানে ধর্ম, অস্ত্র এবং জাতীয়তাবাদ মিশে গিয়ে এক বিপজ্জনক পড়পশঃধরষ তৈরি করেছে। ইরানের কৌশলগত অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি: ইরান শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, এটি একটি আদর্শ ও প্রতিরোধের প্রতীক। পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান কেবল আত্মরক্ষার প্রশ্ন নয়, বরং একটি ‘ভূরাজনৈতিক প্রতিরোধ বলয়’-এর নেতৃত্ব। সিরিয়া, হিজবুল্লাহ, ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী এবং ইরাকের শিয়া মিলিশিয়াদের মাধ্যমে ইরান নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের শাসক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কিন্তু তাদের কৌশল পুরোপুরি প্রতিরক্ষামূলক নয়—তার মধ্যে আক্রমণাত্মক ও আদর্শগত সম্প্রসারণবাদের ছাপও রয়েছে। তেল, গ্যাস, ধর্ম এবং ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব—সব মিলিয়ে ইরান এই অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, এবং সেই অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করতে চায়। ট্রাম্পের ‘তেহরান খালি’ উক্তি সন্ত্রাস নাকি কূটনীতি? ট্রাম্পের বক্তব্যের ধরন অনেক সময় নাটকীয় ও উস্কানিমূলক হয়। কিন্তু যখন তিনি বলেন, “তেহরান এখনই খালি করতে হবে,” তখন সেটি নিছক কথার কথা থাকে না—বরং সেটি মার্কিন যুদ্ধনীতির একটি চূড়ান্ত বার্তা বহন করে। ২০২৫ সালের জুনে তাঁর মধ্যরাতের সময় এই ঘোষণাটি আসে, যেখানে তিনি ‘১০ মিলিয়ন ইরানিকে তেহরান ত্যাগ করার পরামর্শ’ দেন। সম্ভবত এটি আমেরিকার সরাসরি যুদ্ধ অংশগ্রহণের সূচনাকে নির্দেশ করে (সম্ভাবনা বেশি)। আরেকটি সম্ভাবনা হলো—তেহরানে পরমাণু হামলা হতে যাচ্ছে (সম্ভাবনা অত্যন্ত কম)। তবে দুই ক্ষেত্রেই ব্যাপক ধ্বংসের ইঙ্গিত রয়েছে। তারঁ এমন ঘোষণা নিছক অযাচিত নয়, বরং এক অশুভ রাজনৈতিক ভূমিকম্পের ইঙ্গিত। আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে এমন সময়োপযোগী ঘোষণাগুলি সাধারণত পূর্ব পরিকল্পিত সামরিক পদক্ষেপের অগ্রভাগে দেখা যায়। ছায়াযুদ্ধ থেকে সরাসরি সংঘাতে গড়ানো: ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্ব বহু বছর ধরে ছায়াযুদ্ধ বা প্রোক্সি ওয়ারের পর্যায়ে ছিল। ড্রোন হামলা, সাইবার আক্রমণ, গুপ্তঘাতকতা এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও, ২০২৪-২৫ সালে পরিস্থিতি বদলে গেছে। ইসরায়েল যখন সিরিয়ায় ইরানি ঘাঁটি লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়, তখন ইরান সরাসরি ইসরায়েল অভিমুখে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে। এই পাল্টা হামলা যুদ্ধের নিয়মনীতিকে ছাপিয়ে যায়। এটাই ছায়াযুদ্ধের অবসান এবং সরাসরি সংঘাতের শুরু। এই অবস্থায় একটিমাত্র ভুল হিসাব পুরো অঞ্চলকে ধ্বংস করতে পারে। ইরানের পরমাণু কর্মসূচি বাস্তবতা বনাম প্রচারণা: ইরান বলছে তারা পরমাণু অস্ত্র বানাবে না, কিন্তু সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মাত্রা যেভাবে বাড়ছে, তাতে পশ্চিমা দেশগুলোর শঙ্কা ক্রমাগত বাড়ছে। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, আন্তর্জাতিক পরিদর্শকদের সীমিত প্রবেশাধিকার এবং বারবার চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ ইরানকে বিশ্বমঞ্চে একঘরে করে ফেলছে। আবার অন্যদিকে, এই কর্মসূচির অনেক কিছুই ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অতিরঞ্জিত করে প্রচার করা হচ্ছে-যাতে বিশ্বমত গঠনে সুবিধা হয়। এই দ্বৈত বাস্তবতা থেকেই উত্তেজনার সূচনা। রিপাবলিকানদের উগ্র কৌশল: প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র একটি জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল গ্রহণ করেছে, যার মূল উদ্দেশ্য মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা নয় বরং একপ্রকার ‘নিয়ন্ত্রিত সংঘর্ষ’ ধরে রেখে নিজেদের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ সংরক্ষণ করা। এই কৌশল যুক্তরাষ্ট্রকে একদিকে যেমন অস্ত্র বিক্রয়ের বাজার দখলে রাখতে সাহায্য করছে, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলছে। রিপাবলিকানদের এই মনোভাবকে একধরনের “আগ্নেয়াস্ত্রের রাজনীতি” বলা যায়-যেখানে শান্তি নয়, বরং উত্তেজনা ও সংঘাতই মূল চালিকা শক্তি। তারা যুদ্ধের ভয় দেখিয়ে প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ায়, অস্ত্র চুক্তি করে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখে। এভাবে ইসরায়েলকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দেওয়া, ইরানকে চরমভাবে নিষেধাজ্ঞার মুখে ফেলা এবং গাজায় আগ্রাসনকে খোলাখুলি প্রশ্রয় দেওয়া—সবই এই কৌশলের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের উগ্র ও সংকীর্ণ কৌশল বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তার জন্য হুমকি। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের মত স্পর্শকাতর অঞ্চলে এর পরিণতি হতে পারে বিস্ফোরক। রাশিয়া-চীন ও নতুন বলয়ের অভ্যুদয়: বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতিতে রাশিয়া ও চীনের নেতৃত্বে গঠিত নতুন বলয় ক্রমেই পশ্চিমা আধিপত্যের প্রতি একটি সুসংগঠিত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ব্রিকস (ইজওঈঝ) ও সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে তারা নিজেদের কৌশলগত পরিধি বাড়িয়েছে, যাতে ইরানকেও এখন কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই নতুন জোটের মাধ্যমে একটি বিকল্প শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠছে, যার অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এখন আর অবজ্ঞা করার মতো নয়। ইরানকে রাশিয়ার পক্ষ থেকে অস্ত্র ও গোয়েন্দা সহায়তা এবং চীনের অর্থনৈতিক বিনিয়োগ এই জোটকে বাস্তবিকভাবে শক্তিশালী করে তুলছে। এ পরিস্থিতিতে যদি ইউক্রেন যুদ্ধ ও ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একযোগে বেড়ে যায়, তাহলে বিশ্ব একটি বহুপাক্ষিক এবং মারাত্মক সংঘাতের দিকে ধাবিত হতে পারে। এর ফলে ‘নতুন শীতল যুদ্ধ’ নয়, বরং ‘গরম যুদ্ধের যুগ’ সূচিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এটি শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের নিরাপত্তা ও অর্থনীতিকেই ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করতে পারে। বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা: ইরান-ইসরায়েল সংঘাত একটি বৃহৎ পরিসরের বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিতে পারে-এই আশঙ্কা এখন কল্পনা নয়, বাস্তবতা। যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, রাশিয়া, চীন ও ইরান-এই পাঁচটি শক্তি যেকোনো সময় সরাসরি বা প্রক্সি যুদ্ধের মাধ্যমে একে অপরের বিপরীতে অবস্থান নিতে পারে। পরিস্থিতির এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে একটি ভুল তথ্য, একটিমাত্র ভুল বোতাম চাপা, কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর অস্ত্রের একটি ভুল নির্দেশনাও সর্বনাশ ডেকে আনতে পারে। আজকের যুদ্ধ প্রযুক্তিনির্ভর; ড্রোন, স্যাটেলাইট, সাইবার অস্ত্র—সবকিছুই যন্ত্রের হাতে। ফলে মানুষের বিচার-বিবেচনার চেয়ে প্রযুক্তিগত ত্রুটির আশঙ্কাই এখন বেশি। যুদ্ধ মানেই এখন আর সামরিক যুদ্ধ নয়; এটি অর্থনৈতিক যুদ্ধ, সাইবার যুদ্ধ, তথ্য যুদ্ধ এবং কূটনৈতিক সংঘর্ষ—সব একসঙ্গে। এমন বাস্তবতায় বিশ্ব যদি এখনই যুদ্ধনির্ভর রাজনীতি থেকে সরে না আসে, তাহলে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কেবল সময়ের অপেক্ষা হয়ে থাকবে। গাজা ও ফিলিস্তিন সংকটের প্রভাব: গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। হাজার হাজার শিশু, নারী ও নিরস্ত্র নাগরিকের মৃত্যুতে বিশ্বব্যাপী মানবিক অনুভূতি জেগে উঠলেও, কার্যকর পদক্ষেপে ব্যর্থ হয়েছে অধিকাংশ সরকার। জাতিসংঘের প্রস্তাব বারবার আটকে যাচ্ছে, আর পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বৈত আচরণ ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীর করছে। গাজার এই রক্তপাত কেবল মানবিক বিপর্যয় নয়, বরং এটি গোটা মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিতিশীলতাকে উসকে দিচ্ছে। আরব দেশগুলোর জনমনে ক্ষোভ বাড়ছে, ইসলামী বিশ্বের রাজনৈতিক চেতনায় উত্তাল হয়ে উঠছে ক্ষোভ। এই সংঘাত এখন শুধুই এক প্রান্তিক ভূখণ্ডের নয়, বরং একটি প্রতীক—বঞ্চনার, দখলদারিত্বের ও নিপীড়নের। এই প্রভাব সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও রাজনৈতিক চরমপন্থার উত্থান ঘটাতে পারে। তাই গাজার সংকটকে আলাদা কোনো ইস্যু হিসেবে না দেখে বিশ্বশান্তির বড় সংকট হিসেবে দেখা জরুরি। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দ্বৈত মান: ইউরোপীয় ইউনিয়ন বরাবরই নিজেকে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের রক্ষাকর্তা হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। ইউক্রেন যুদ্ধের সময় তারা সরবভাবে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়ে অবরোধ আরোপ, অস্ত্র সহায়তা এবং মানবিক সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু গাজা, ইরান বা মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য সংকটের বেলায় তারা একেবারেই নিরুত্তাপ, প্রায় নিষ্ক্রিয়। এই দ্বৈত নীতির ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নৈতিক অবস্থান এখন প্রশ্নবিদ্ধ। মুসলিম বিশ্বে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ইউরোপের প্রতি আস্থা কমছে। মানবাধিকার কি কেবল ইউরোপীয় নাগরিকদের জন্য প্রযোজ্য?—এই প্রশ্ন এখন সর্বত্র উঠছে। ইউরোপের এ নীতিক বৈষম্য আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিশ্বাসযোগ্যতা ও প্রভাব দুই-ই খুইয়ে দিচ্ছে। আর এতে লাভবান হচ্ছে রাশিয়া-চীন, যারা নিজেদের ‘পশ্চিম-বিরোধী’ বলয়ের নেতৃস্থানীয় শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। জাতিসংঘের অকার্যকারিতা: জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। কিন্তু বর্তমানে এই সংস্থাটি কার্যত ‘নির্বাক দর্শক’ বা ‘বিবৃতির কারখানা’তে পরিণত হয়েছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো ক্ষমতার কারণে যেকোনো মানবিক প্রস্তাবও আটকে যাচ্ছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির একাধিক প্রস্তাব, চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা প্রবেশের আবেদন, এমনকি যুদ্ধাপরাধের তদন্ত—ধষষ কিছুই যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় ব্যর্থ হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষের মনে জাতিসংঘের প্রতি আস্থা হারিয়ে যাচ্ছে। যদি কোনো সংস্থা বড় শক্তিদের সামনে নতিস্বীকার করতে থাকে, তবে তার কার্যকারিতা থাকে না বললেই চলে। জাতিসংঘের এমন নৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক দেউলিয়াত্ব শুধু ইসরায়েল-ইরান সংকট নয়, ভবিষ্যতের সব ধরনের সংঘাতে আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধ ও ন্যায্যতার ভিত্তিকে দুর্বল করবে। পরমাণু অস্ত্রের হুমকি ও প্রতিক্রিয়া: বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হলো-পরমাণু অস্ত্রের প্রতিযোগিতা। ইসরায়েলের কাছে গোপনে শতাধিক পরমাণু বোমা রয়েছে বলে দীর্ঘদিন ধরে ধারণা রয়েছে, যদিও তারা কখনো আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বীকার করেনি। অন্যদিকে, ইরান দীর্ঘদিন ধরেই পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে আসছে, যার অগ্রগতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব উদ্বিগ্ন। যদি ইরান পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত হয়, তাহলে শুধু ইসরায়েল নয়—আরব প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলোও (যেমন সৌদি আরব, তুরস্ক, মিশর) এই অস্ত্র তৈরির দিকে ঝুঁকবে। এই প্রতিযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি সম্ভাব্য পরমাণু যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ দিতে পারে। তাছাড়া, এমন একটি অঞ্চলে যেখানে আঞ্চলিক উত্তেজনা সবসময় তীব্র, সেখানে পারমাণবিক অস্ত্র মানে এক ভয়াবহ ভবিষ্যৎ। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যদি এখনই এ প্রতিযোগিতা নিয়ন্ত্রণে না আনে, তাহলে আগামী দশকে বিশ্ব এমন এক পরিণতির দিকে এগোবে যা ঠেকানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান: ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতে বাংলাদেশ সরাসরি জড়িত না হলেও এর পরোক্ষ প্রভাব থেকে নিস্তার নেই। কারণ, মধ্যপ্রাচ্যই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেমিট্যান্স বাজার। প্রায় ৮০ লাখ বাংলাদেশি এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে কর্মরত। এই সংঘাত বিস্তৃত হলে তাদের চাকরি হারানো, নিরাপত্তা হুমকি কিংবা ফেরত আসার আশঙ্কা বাড়বে। এর ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও শ্রমবাজারের দিক থেকে। এ ছাড়া, বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাসের দাম বাড়লে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক চাপে পড়বে। দেশজ মুদ্রার অবমূল্যায়ন, মুদ্রাস্ফীতি এবং বৈদেশিক ঋণের ওপর চাপ বাড়বে। রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে থাকলেও কূটনৈতিকভাবে প্রস্তুত না থাকলে দীর্ঘমেয়াদে বিপদ বাড়তে পারে। এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের উচিত হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা, প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগেভাগে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালানো এবং বিকল্প শ্রমবাজার খোঁজার প্রস্তুতি নেওয়া। একই সঙ্গে জাতিসংঘে মানবিক অবস্থান গ্রহণ করে শান্তির পক্ষে সক্রিয় কূটনীতি চালানোও সময়োপযোগী হবে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা: সামাজিক মাধ্যম বর্তমানে একটি প্রধান যুদ্ধক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে, যেখানে তথ্য নয়—‘তথ্য-অস্ত্র’ ব্যবহৃত হচ্ছে। ফেসবুক, এক্স (টুইটার), ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মে প্রতিনিয়ত ইসরায়েল ও ইরানপন্থী প্রচারণা চালানো হচ্ছে। একদিকে ইসরায়েল সেনাবাহিনী প্রোডাকশন হাউসের মতো ভিডিও বানিয়ে ‘নির্ভুল হামলা’ প্রচার করছে, অন্যদিকে ইরানপন্থীরা শহীদ শিশুদের ছবি ভাইরাল করে জনমত গঠনের চেষ্টা করছে। মাঝখানে সাধারণ মানুষ পড়ে যাচ্ছে বিভ্রান্তিতে। ভুল তথ্য, এডিট করা ছবি, মিথ্যা ভিডিও ও গুজব এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যে—নীতিনির্ধারকরাও অনেক সময় সত্য-মিথ্যা আলাদা করতে পারছেন না। সবচেয়ে ভয়ংকর দিক হলো-এই প্রোপাগান্ডা অনেক সময় যুদ্ধকে আরও ঘনীভূত করে তোলে, কারণ জনগণের আবেগের চাপে সরকারগুলো চরমপন্থী অবস্থান নেয়। একইসঙ্গে, সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে সত্য প্রতিষ্ঠার জায়গাটি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে বিশ্বজনমত নিয়ন্ত্রণের ভার গুটিকয়েক প্রযুক্তি কোম্পানির হাতে চলে যাবে, যা গণতন্ত্র ও মানবাধিকার উভয়ের জন্য হুমকি। ধর্মীয় উগ্রতা ও বিভাজন: ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এখন আর কেবল রাজনৈতিক নয়—এটি এক ভয়ংকর ধর্মীয় বিভাজনে রূপ নিচ্ছে। ইহুদি-মুসলিম দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক আবরণে বর্তমান যুদ্ধ ঢুকে পড়েছে, যার ফলে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় বিদ্বেষ বাড়ছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় মসজিদে হামলা, মুসলিমদের ওপর হেট ক্রাইম, হিজাব নিষিদ্ধের দাবি, ধর্মীয় কটূক্তি ও বর্ণবৈষম্য—ধষষ কিছু বেড়ে চলেছে। অপরদিকে, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি প্রতীক বা সিনাগগে আক্রমণ, ইহুদি বিরোধী শ্লোগান ও সহিংস বিক্ষোভ বেড়েছে। এই পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক উত্তেজনা নয়-সভ্যতার মধ্যে বিভাজন তৈরির এক নতুন পথ খুলে দিয়েছে। ‘ক্রুসেড বনাম জিহাদ’ জাতীয় ভাষায় লড়াই বর্ণনা করা হচ্ছে, যা বিশ্ব রাজনীতিতে চরমপন্থার পুনরুত্থান ঘটাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মাঝে উগ্রতা ও সহিংসতার প্রতি এক ধরনের রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হচ্ছে, যা ভবিষ্যতে আরো অনেক চরমপন্থী গোষ্ঠীর জন্ম দিতে পারে। এই ধর্মীয় মেরুকরণ রোধে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ, শিক্ষা ও বিশ্বমাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ কণ্ঠের প্রয়োজন এখনই। মানবিকতার পুনর্জাগরণ প্রয়োজন: যুদ্ধের ভয়াবহতা যতই বাড়ুক না কেন, শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়-এই বাস্তবতা সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। শিশুদের রক্ত, ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়া ভবিষ্যৎ, উদ্বাস্তু জনস্রোত—এসব কোনো কৌশলের অংশ হতে পারে না। এখন সময় এসেছে বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করার। শান্তি প্রতিষ্ঠায় নাগরিক সমাজ, মানবাধিকার সংস্থা, শিক্ষাবিদ, শিল্পী, সাংবাদিক, এমনকি সাধারণ মানুষের ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বড় শক্তিগুলো যখন নিজ নিজ কৌশলগত স্বার্থে মানবতা বিসর্জন দেয়, তখন প্রয়োজন হয় নিচ থেকে শান্তির দাবিতে আওয়াজ তোলা। যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন, অনলাইন ক্যাম্পেইন, গণস্বাক্ষর, আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এখন অত্যাবশ্যক। শুধু কূটনীতি নয়-মানবিকতা এখন আমাদের অস্ত্র হওয়া উচিত। কারণ, যুদ্ধ বন্ধ না হলে—শুধু গাজা বা তেহরান নয়, আমাদের ভবিষ্যৎই ধ্বংসের মুখে পড়বে। এই মুহূর্তে শান্তির পক্ষে দাঁড়ানো মানে কেবল রাজনৈতিক বিবৃতি নয়, বরং একটি সভ্যতা রক্ষার প্রতিজ্ঞা। উপসংহার: ইসরায়েল-ইরান সংকট এখন আর কেবল দুই রাষ্ট্রের মধ্যকার উত্তেজনা নয়, এটি এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা হুমকি। এ অবস্থায় সামরিক সমাধান নয়, চাই কূটনৈতিক সংলাপ, মানবিক দৃষ্টি ও ন্যায়বিচারভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা। না হলে এই আগুন শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা মানবজাতিকে পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। |