![]() নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা, পক্ষতামূলক ভূমিকায় ইউজিসি!
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হঠাৎ করেই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রাস্টি লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন নিজেদের নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এর অংশ হিসেবে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দফা হামলা-লুটপাটও চালান। তারা বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের হুমকি-ধমকির মধ্যে রেখেছেন। দখল পেতে আবেদন করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। সূত্র জানিয়েছে, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে সাবেক এই ট্রাস্টি সদস্যরা সুপরিকল্পিত একটি ‘সিন্ডিকেট’ গড়ে তুলেছেন। সিন্ডিকেটে ভেড়ানো হয়েছে একজন ইউজিসি সদস্যকে। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুই-একজন ও এই সিন্ডিকেটে কাজ করেছেন। সিন্ডিকেট কর্মকাণ্ডের অংশ হিসেবে ইউজিসির সদস্য প্রথমে অভিযোগকারীদের আস্থাভাজন অধ্যাপক নোমান ফারুক দিয়ে তদন্ত কমিটি করেন। কিন্তু আপত্তির মুখে সেই কমিটি বাতিল করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ফের কমিটি করা হয়। কিন্তু এই কমিটিতেও অভিযোগকারীদের ঘনিষ্ঠজন ও স্বৈরাচারের দোসর মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনকে আহ্বায়ক করা হয়। কোনো তদন্তসহ সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) রয়েছে নিজস্ব টিম, কর্মকর্তা ও লিগ্যাল উইং। কিন্তু তা সত্ত্বেও নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা তদন্তে নিয়োগ দেওয়া হয় বাইরে তাও আবার অভিযোগকারীদের ঘনিষ্ঠজন। এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, ইউজিসির অভিযুক্ত সদস্য নর্দান দখলের অভিলাষকারীদের সঙ্গে ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। শিক্ষাবিদরা বলছেন, শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় ব্যক্তির অশুভ তৎপরতার মুখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) যথাযথ ভূমিকা জরুরি ছিল। অথচ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারককারী এ সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য দখল-কব্জার দ্বন্দ্বে ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ হয়ে পড়েছে। ইউজিসির ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ তদন্ত কমিটি গত ৫ আগস্টের পর নিজেদের ট্রাস্টি পরিচয় দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দখল ফিরে পেতে আবেদন করেন লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দীন। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করে ইউজিসি। সেই কমিটি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে পুনরায় তিন সদস্যের আরেকটি কমিটি করা হয়। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কয়েকজন সিন্ডিকেট সদস্যের অভিযোগ, এ তদন্ত কমিটি গঠনের প্রক্রিয়ায় প্রভাব খাটানো এবং লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মনোনীত করার চেষ্টায় জড়িয়ে পড়েন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন। প্রথম দফার বিতর্কের পর দ্বিতীয় দফায় গঠিত কমিটির আহ্বায়ক করা হয় স্বৈরাচারের দোসর সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আলতাফ হোসেনকে। আলতাফ হোসেন আওয়ামী লীগের শাসনামলে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সচিব ও অগ্রণী ব্যাংকসহ অনেক প্রতিষ্ঠানে সুবিধাভোগী হিসেবে চুক্তিভিত্তিতে লিগ্যাল অ্যাডভাইজর হিসেবে কাজ করেন। গত ২৯ এপ্রিল তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন নর্দানের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। একই সঙ্গে তারা উচ্চ আদালতে এ নিয়ে রিট করেন। শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়কে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টার মুখে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে না পারায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান অস্থিরতার দিকে নজর রাখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক বলেন, ইউজিসির একজন সদস্যের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ উদ্বেগজনক। ইউজিসির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার একজন সদস্য যদি ব্যক্তিস্বার্থে কাজ করেন, তাহলে তার দায়িত্বে থাকার ন্যূনতম নৈতিক অধিকার নেই। উল্লেখ্য, নর্দান ট্রাস্টি বোর্ডের সাবেক কয়েকজন সদস্য ২০১১ সালে এনইউবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে এবং আর্থিক সংকটে পড়লে তৎকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের অধিকাংশ সদস্য আইন অনুযায়ী পদত্যাগ করেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লুৎফর রহমান ও বোরহান উদ্দিন। পরবর্তীসময়ে গঠিত নতুন ট্রাস্টি বোর্ড দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছেন। দুই সদস্যদের সম্মতি ছাড়াই প্রতিবেদন জমা নর্দানের ঘটনা তদন্তে দ্বিতীয় দফায় অভিযোগকারীদের ঘনিষ্ঠ মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনকে আহ্বায়ক করা হয় ।সদস্য সচিব ও সদস্য করা হয় যথাক্রমে সেজুতি আকবর এবং নাসিমা আক্তার খাতুনকে। সূত্র জানিয়েছে, নর্দান নিয়ে আলতাফ হোসাইন অভিযোগকারীদের অনুকূলে পক্ষপাতিত্বমূলক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। গত ২৮ এপ্রিল তিনি ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক ড. মো. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়ার দপ্তরে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। ইউজিসি সূত্র জানিয়েছে, পক্ষপাতিত্বমূলক রিপোর্টের আশঙ্কায় বাকি দুই সদস্য ( সেজুতি আকবর এবং নাসিমা আক্তার খাতুন) মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইনকে দুই পাতার একটি খসড়া রিপোর্ট চূড়ান্ত করার অনুরোধ করেন। কিন্তু মোহাম্মদ আলতাফ হোসাইন সেটা না করে নিজের রিপোর্টটি দাখিল করেন। উল্লেখ্য, সদস্য সেজুতি আকবর আলতাফ হোসানইকে একটি রিপোর্ট পাঠালেও তিনি সেটি আমলে নেননি। বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা-লুটপাট ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হয়। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সুযোগ নিয়ে দু-দিন পরই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক ট্রাস্টি বোরহান উদ্দিন ও লুৎফর রহমান সানির নেতৃত্বে হামলার ঘটনা ঘটে। তারা উপাচার্যকে জিম্মি করে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের চেষ্টা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বেশ কয়েকজন শিক্ষক-শিক্ষার্থী এতে আহত হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ সময় ঘটনাকে তারা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বোরহান উদ্দীন ও লুৎফর রহমানকে আটক করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। কিছুদিন পরই বনানীর প্রাসাদ ট্রেড সেন্টারে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করা হয়। অফিসে সেদিন লুটপাটের ঘটনাও ঘটে। একই সময়ে নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যানসহ ট্রাস্টি বোর্ডের প্রায় সবাইকে আসামি করে জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের হত্যা মামলা করা হয়। ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ বর্তমান সদস্যদের অভিযোগ, রাজনৈতিক অস্থিরতা পুঁজি করে একটি চক্র বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে লুটপাট করেছে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যদের নামে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন মামলা করেছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক সামসুল হকের কাছ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় দখলের জাল দলিলে সই করানোর অপচেষ্টাও চালানো হয়। এ ঘটনায় বনানী থানায় অভিযোগ করা হয়। দ্বন্দ্ব নিয়ে বিশ্ববিদ্যালটির বর্তমান রেজিস্ট্রার মোস্তফা বলেন, ‘নর্দান ভার্সিটি প্রতিষ্ঠানলগ্নে আইবিএটি ট্রাস্টের মাধ্যমে পরিচালিত হতো। সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী আমানত দেখিয়ে প্রচুর ব্যাংক ঋণ নেওয়া হয়, যা ট্রাস্টিরা ভাগ করে নেন। ২০১০ সালে সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা নীতিমালা তৈরি করে। তখন স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণের প্রয়োজন হয়। কিন্তু আগের ট্রাস্টিরা বিনিয়োগে ব্যর্থ হন। পরে ২০১১ সালের ২৭ জুলাই বোরহান উদ্দিন, লুৎফর রহমান পদত্যাগ করেন এবং তারা তাদের প্রাপ্য হিস্যা নিয়ে যান। যার রেকর্ডও আছে। একই সঙ্গে অধ্যাপক ইউসুফ আব্দুল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সব দায়-ঋণ পরিশোধ করেন। অভিযোগকারীদের বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয় দখলে নিতে মরিয়া সাবেক ট্রাস্টি বোরহান উদ্দিন জানান, দায়-দেনা পরিশোধ না করে ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ আলাদা ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। যার সব সদস্যই তার নিকটাত্মীয়। এরপর পুরোনো ট্রাস্টিদের বের করে তিনি প্রতিষ্ঠানটি দখল করেন। হামলা-লুটপাট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের ডেকেছিল। আমরা কথা বলতে গিয়েছিলাম। পরে তারা সেনাবাহিনী ডেকে আমাদের তাদের হাতে তুলে দেয়। আমরা কোনো হামলা-লুটপাট করিনি। অথচ তারা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, জেলে পাঠিয়েছে।’তবে বোরহান উদ্দিনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকার তথ্য ‘মিথ্যা ও ভিত্তিহীন’ বলে দাবি করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষক ও সিন্ডিকেট সদস্যরা। তাদের দাবি, তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েই নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে হামলায় নেতৃত্ব দেন। পক্ষপাতমূলক তদন্ত কমিটি নিয়ে ইউজিসির বক্তব্য তদন্ত কমিটি গঠনে পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ প্রসঙ্গে ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন গণমাধ্যমে বলেন, কোনো ধরনের পক্ষপাতের ঘটনা এখানে ঘটেনি। তারা দুই পক্ষ দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে। সেটি সরকার আমাদের দেখতে বলেছে। আমরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করেছি। ইউজিসির নিরপেক্ষতার বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে দাবি করেন সংস্থার চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। তিনি বলেন, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে দুটি পক্ষ হয়ে গেছে। এই দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছে। তাদের এমন মনোভাবের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। এটি চলতে পারে না, এটা নৈরাজ্য। |