![]() শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়ন্ত্রণহীন বিশৃঙ্খলা
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সম্প্রতি রাজধানীর বনানীতে হাসাহাসির মতো তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রাইম এশিয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম পারভেজকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ওই ঘটনাতেও দেখা যায়, শিঙাড়া খাওয়ার সময় দুই বহিরাগত নারী শিক্ষার্থীকে দেখে পারভেজ হাসাহাসি করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। এরপর তাকে প্রক্টরের রুমে তলব করা হয়। পারভেজ তাদের কাছে ক্ষমাও চান। এরপর বহিরাগতদের ডেকে এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অস্ত্রের মহড়া দেয়া হয়। সেই মহড়া থেকেই দৌড়ে গিয়ে পারভেজকে জাপটে ধরে মারধর করে বুকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। আর এসব কিছুই হয় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে প্রকাশ্যে। সেখানে নিরাপত্তাকর্মীরা উপস্থিত থাকলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো গেট বন্ধ করে দেন। এই হত্যাকাণ্ডের মামলার প্রধান আসামি, বনানী থানার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করে রিমান্ডেও নিয়েছে পুলিশ। বিশ্ববিদ্যালয়টির পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। এদিকে কয়েকদিন পরপরই সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা সিটি কলেজ ও ঢাকা কলেজ এবং আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ওই সংঘর্ষে কখনো ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা আইডিয়াল কলেজের সাইনবোর্ড খুলে আনছে, কখনো আবার সিটি কলেজে গিয়ে হামলা করে কলেজের নামফলক ভেঙে নিয়ে আসছে। সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা আবার ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজের ড্রেস পরা যাকে পাচ্ছে তাকেই বেধড়ক পেটাচ্ছেন। আবার সিটি কলেজে হামলা করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গ্রুপ খুলে আগে থেকে ঘোষণা দিচ্ছে আইডিয়ালের শিক্ষার্থীরা। চলন্ত বাসের মধ্যে উঠে মারধর করা হচ্ছে। ভাঙচুর করা হচ্ছে যাত্রীবাহী বাস। শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে আতঙ্কের পাশাপাশি পুরো এলাকাতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। কলেজ ড্রেস পরে সায়েন্সল্যাব এলাকায় নিত্যদিনের সাপে-নেউলে এই লড়াইয়ে যেন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে এলাকাটি দিয়ে চলাচল করা সাধারণ মানুষ। গত ২২শে এপ্রিলও দেখা যায়, ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সিটি কলেজে হামলা করে তাদের কলেজের নামফলক-লোগো তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় যাত্রীবাহী বাসও ভাঙচুর করা হয়। পুরো এলাকায় দিনভর আতঙ্ক বিরাজ করে। পরে পুলিশ টিয়ারশেল ও লাঠিচার্জ করে উভয়পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। তখন ঘটনাস্থল থেকে একাধিক শিক্ষার্থীর কাছে সংঘর্ষের কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা বলতে পারেননি। তারা শুধু অপর পক্ষকে দোষারোপ করে বলেন- ওরা আমাদের কলেজের ছাত্রকে মেরেছে। অন্যদিকে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ঢাকাসহ সারা দেশেই চলছে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কর্মসূচি। চাকরি, পদোন্নতি ও উচ্চশিক্ষার নিশ্চয়তাসহ ৬ দফা দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছেন তারা। ইতিমধ্যে তারা জেলা, বিভাগীয় এবং ঢাকায় মহাসমাবেশেরও কর্মসূচি পালন করেছেন। গতকাল সকালেও রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল বের করেন তারা। পরে তাদের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সচিবালয়ে বৈঠকও হয়েছে। গত ২২শে এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সভা করেন কারিগরি ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। তবে দাবি আদায় না হওয়ায় তারা আবারো কর্মসূচি ঘোষণা করেন। একই সময়ে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ভিসির পদত্যাগের একদফা দাবি ওঠে। যেই আন্দোলনের ঢেউ ঢাকাতেও দেখা যায়। কুয়েট ভিসি’র পদত্যাগের দাবিতে ঢাকায় এসে শাহবাগে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। কুয়েটের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আন্দোলনে নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ভিসিসহ কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করতে হয়। পিএসপি সংস্কারের দাবিতেও সরগরম বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ও বিক্ষোভ মিছিলের পাশাপাশি রাজধাশাহীতেও ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয় রাবি’র শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে গত শনিবার শিক্ষার্থীদের তীব্র আন্দোলনের মুখে অবশেষে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির (ইউআইইউ) ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আবুল কাশেম মিয়া। তার সঙ্গে বেসরকারি এই বিশ্ববিদ্যালয়টির সকল অনুষদের ডিন, বিভাগীয় প্রধান ও ইনস্টিটিউটের পরিচালকও পদত্যাগ করেছেন। এরপরও শনিবার রাতে ভিসিসহ অন্তত ২৫ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এরকম একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) অধ্যাপক পারভীন সুলতানা হায়দার বলেন, এটা সত্য যে আগের তুলনায় আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিছু না হতেই তারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। তবে এসব দ্বন্দ্ব শুরু হয় হাতেগোনা ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে। পরে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হয়ে সকল শিক্ষার্থী এতে যোগ দেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে সংঘর্ষ বড় হয়। অনেক সময় দেখা যায় শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই জানেন না তারা কেন অন্য কলেজের সঙ্গে বিবাদ করছে। আমরা এসব ঘটনা জানার সঙ্গে সঙ্গে তাদের নিভৃত করার চেষ্টা করি। কিন্তু সব সময় তা হয়ে ওঠে না। ইতিমধ্যে আমরা গত ২৩শে এপ্রিল রমনা জোনের ডিসি মাসুদ আলমকে নিয়ে ঢাকা সিটি কলেজ, আইডয়াল কলেজসহ আশেপাশের ৫টি কলেজের পক্ষ থেকে ধানমণ্ডি থানায় বৈঠক করে একটি চুক্তি করেছি। এ ছাড়াও আমরা চেষ্টায় আছি যেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই সংঘর্ষের ঘটনা আর না ঘটে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, আগে আমরা দেখেছি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো ঝামেলা হলে তা চড়, কিল, ঘুসি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকতো। পরে আবার সবাই মিল হয়ে যেতো। কিন্তু এখন দেখা যায় কোনো কিছু হলেই মব সৃষ্টি করে হামলা করা হচ্ছে। এসব হামলায় শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষার্থীদের জীবন পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও সমাধান হচ্ছে না। দ্বন্দ্ব থামছে না। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা। তাদের এই বেপরোয়া আচরণের জন্যই একের পর এক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেই চলেছে। শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, সারা দেশের শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সংকট মোকাবিলার জন্য কাজ করছে সরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান অস্থিরতার ব্যাপারে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বিগ্ন এবং এটা যেন আর না ঘটে তার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তিনি বলেন, আগে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করার মতো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। যখনই কেউ কোনো দাবি উত্থাপন করতো তখন রাষ্ট্র তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। এখন সেই অবস্থা নেই। আমরা সমস্যা সমাধানে চেষ্টা করে যাচ্ছি। |