![]() বন্দুকযুদ্ধের ‘নাটক’ সাজিয়ে করা হয় পঙ্গু
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সালে সাতক্ষীরা জেলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় ও সাজানো ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নিয়ে এসব কথা বলেন সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগীরা। যারা এখনো পঙ্গুত্ব বয়ে বেড়াচ্ছেন; অনেকেই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরায় চলে তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক ধরপাকড়। স্থানীয়রা জানান, পুলিশে রাজনীতিকরণ হওয়ায় ভিন্ন মত বা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দমনে জেলার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টার্গেটে পরিণত হন অনেকেই। সাতক্ষীরাজুড়ে বন্দুকযুদ্ধের অসংখ্য ঘটনা সাজায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাশকতা দমনের নামে পরিকল্পিত এই মিশনকে বলা হয় ‘বন্দুকযুদ্ধ’। তবে চ্যানেল 24 এর অপরাধ ও অনুসন্ধানমূলক অনুষ্ঠান সার্চলাইটের প্রতিবেদনে বেশকয়েকটি সাজানো বন্দুকযুদ্ধের চিত্র উঠে এসেছে। ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নাটক সাজিয়ে কীভাবে পঙ্গু করে দেয়া হয় তার বিস্তারিত উঠে আসে প্রতিবেদনে। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই বিরোধী দল বা প্রতিপক্ষের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অনেকেই আবার সাধারণ মানুষও ছিলেন। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, পায়ে গুলি করে পঙ্গু করার পদ্ধতিকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘নী ক্যাপিং’। এটি নির্যাতনের সহিংস একটি পদ্ধতি; এমনকি বিচারবহির্ভূত শাস্তিও। ‘নী ক্যাপিং’ নির্যাতনের এমন ভয়াবহতা; যেখানে কারো হাঁটুতে বা হাঁটুর নিচে কিংবা আশপাশে পরিকল্পিতভাবে গুলি বা আঘাত করা হয়। ‘ক্রসফায়ারে হত্যা’ না করে আংশিকভাবে অক্ষম করে দেয়া হয়। এতে ভুক্তভোগী সারা জীবনের জন্য পঙ্গুত্ববরণ করেন, এই ‘নী ক্যাপিং’ আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনও। ভুক্তভোগীদের একজন সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার আব্দুর রউফ। সে সময় তিনি ইউনিয়ন বিএনপির ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। নাশকতার অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে পায়ে গুলি করে। সেই থেকে পঙ্গু জীবন পার করছেন তিনি। এক পায়ে ভর করে কোনোরকম দিন চলছে তার। ২০১৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ঘটনা। সেদিনের রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আব্দুর রউফ বলেন, ‘ওই দিন মধ্যরাতে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ট্রাকে করে নেয়া হয় স্থানীয় সখিপুর কলেজ মাঠে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হাঁটুর নিচে গুলি করে পুলিশ।’ তিনি বলেন, ‘আগে কোনো মামলা ছিল না, রাজনীতিতে জড়িত থাকায় ধরে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে গুলি করে। ভেবেছিলাম আমাকে মেরেই ফেলবে, যখন পায়ে গুলি করা হয় বারবার শুধু সন্তানদের কথা মনে পড়ছিল। সেদিনের ঘটনার ভয়াবহতা বলছিলেন আর কান্না করছিলেন আব্দুর রউফ। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে নেয়ার পর পর্যাপ্ত চিকিৎসা পাইনি। প্রথমে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়, সেখানে বলে চিকিৎসা না দেয়ার নির্দেশনা আছে; এভাবে ৩ দিন ফেলে রাখার পর অনুরোধ করলে খুলনায় পাঠায়, ওখানেও একই কথা বলে। এভাবে কোনো রকম চিকিৎসা দিয়ে ১৬ দিনের মতো পার করে। এই সময়ে পা পচে গন্ধ বের হয়। পরে পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হলে পা কেটে ফেলে।’ এ ঘটনার পর ছয় জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত এক থেকে দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলা করেন দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই বছির উদ্দীন। অভিযোগে বলা হয়, বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা আগ্নেয়াস্ত্র, ককটেল, লাঠিসোঁটা ও দা নিয়ে যৌথবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। আত্মরক্ষায় পাল্টা গুলি ছোঁড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দুষ্কৃতিকারীদের গুলিতে দুইজন গুলিবিদ্ধ হন; এ ছাড়া দুষ্কৃতিকারীদের করা বিস্ফোরণে আরো দু’জন মারাও যান। সেদিন আব্দুর রউফের ভাগনে তৎকালীন ছাত্রদল নেতা রিয়াজুল ইসলামকেও তুলে নিয়ে হাঁটুর নিচে গুলি করা হয়। সেই থেকে রিয়াজুলও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রাণে বেঁচে ফিরলেও, এখনও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন রিয়াজুল। তিনি বলেন, ‘২০১৩ সালের আগ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণে সাজানো বন্দুকযুদ্ধে তিনিও নী ক্যাপিংয়ের শিকার। পায়ে গুলি করার পর থেকে সেটি এখন অকেজো। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিচারবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ডে কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি। উল্টো ভুক্তভোগীদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী এবং নাশকতাসহ রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ তোলা হয়। সেদিন সখিপুর কলেজ মাঠে কী ঘটেছিলো তা জানতে প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুর রউফ ও তার ভাগনে রিয়াজুলকে গুলি করা দেখেছেন তাদেরই একজন জহুরা খাতুন। সখিপুর কলেজ মাঠের পাশেই তার বাড়ি। প্রত্যক্ষদর্শী জহুরা খাতুন বলেন, ‘কলেজ মাঠের একপাশে একজনকে গুলি করে, আরেকটু ফাঁকে নিয়ে অন্যজনের পায়ে গুলি করে। আমরা হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। ওই দিন এখানে কোনো নাশকতা কিংবা যৌথ বাহিনীর উপর হামলার ঘটনা ঘটেছিলো কিনা? এমন প্রশ্নে জহুরা জানান, ‘আক্রমণের কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশের উপর হামলা ককটেল নিক্ষেপের মতো কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’ দুজনকে পায়ে গুলি করার বিষয়টি তার সঙ্গে আরো অনেকেই দেখেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী মাহফুজা খাতুনও সেদিন ঘটনাস্থলের পাশেই অবস্থান করছিলেন। তিনি জানান, ‘একজনকে মাঠের মধ্যে পায়ে গুলি করে, আরেকজনকে পাশেই গুলি করে পুলিশ। আমি নিজের চোখে দেখেছি। পারুলিয়ার দিক থেকে তাদের আনা হয়েছিল।’ ওই দিন সখিপুর কলেজ মাঠে পুলিশের ওপর কোনো হামলা হয়নি’। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আরো কয়েকজন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন, তারাও জানিয়েছে, ওই দিন কলেজ মাঠে কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের করা নাশকতার সেই মামলায় মোট সাক্ষী ২৮ জন। এদের মধ্যে নিরপেক্ষ তিনজন, বাকি সাক্ষী পুলিশ ও চিকিৎসক। মামলার নথি ধরে নিরপেক্ষ তিন সাক্ষী জানান, মনগড়া কথা লিখে শুধু সই নেয়া হয়েছে। ঘটনা সম্পর্কে কিছু না জানলেও তাদের সাক্ষী করা হয়েছে। দুজন সাক্ষী জানেনই না তারা এই মামলার সাক্ষী। পুলিশের এজাহার ও তদন্ত প্রতিবেদনেও রয়েছে গরমিল। পুলিশের এজাহারে দু’জনের মৃত্যু ও দু’জন গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা বলা হলেও; তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সেদিন হতাহতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। প্রশ্ন হলো হতাহতের ঘটনা না ঘটলে আব্দুর রউফ এবং রিয়াজুল ইসলামের পায়ে গুলি লাগলো কীভাবে? দেবহাটা উপজেলার গড়ানবাড়িয়া এলাকার রুহুল আমীনের ঘটনাও একই রকম। রুহুল আমিনের এক পা কেড়ে নেয়া হয়েছে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ নামের সাজানো নাটকে। যদিও এক দশক আগেও স্বাভাবিক জীবন ছিল তার, ফুটবল খেলায় পারদর্শী হওয়ায় এলাকায় বেশ সুনামও ছিল রুহুল আমিনের। ২০১৫ সালের ২৫ জুলাই সন্ধ্যায় বাড়িতেই অবস্থান করছিলেন রুহুল আমিন। হঠাৎ বাড়ি ঘিরে ফেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাকে জোর করে থানায় নেয়া হয়। তিনি বলেন, ‘থানায় নেয়ার পর অনেক নির্যাতন করে, পরে আমার হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। এরপর রাতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে সেখানে ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে। এরপর পায়ে গুলি করে।’ তিনি বলেন, ‘তখন মনে হয়েছিল পুলিশ আমাকে মেরে ফেলবে। গুলি করার পর মনে হলো সব কিছু কেমন উলটপালট হয়ে গেছে। পরে হাসপাতালে নেয়ার সময় আমি পানি চাই, একটু পানি খাওয়ার পর কিছুটা জ্ঞান ফিরলে বলে এতো শুয়োরের জান, এতক্ষণতো হয়ে যাওয়ার কথা। হাসপাতালে নেয়ার পর ঠিকমতো চিকিৎসা দেয়নি। বলে নির্দেশনা আছে, পা কেটে ফেলতে হবে। পরে পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে পা কেটে ফেলে। টার্গেট ছিল মেরে ফেলা, পরে যখন বেঁচে গেছি তখন পঙ্গু করে দিয়েছে, যেন ভবিষ্যতে দাঁড়াতে না পারি।’ তৎকালীন সরকারি দলের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনে পুলিশ এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, পায়ে গুলি করার পর হাসপাতালে নেয়া হলেও তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হয়নি। ফলে অনেকের পা কেটে ফেলা হয়েছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগীর বক্তব্য এমনই। এ ঘটনায় দেবহাটা থানার তৎকালীন এসআই মনিরুল ইসলাম বাদি হয়ে একটি মামলা করেন। অভিযোগের ধরনটাও একই। এজাহারে বলা হয়, ঘোনাপাড়া এলাকায় জাকির মেম্বারের হ্যাচারির সামনে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা গোপন মিটিং করছিল। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে গুলি ও বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। সেখানে ১০-১২ মিনিট গোলাগুলির পর রুহুল আমীনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। মামলার সাক্ষী শামসুর রহমান গাজী। তিনি জব্দ তালিকার ২ নাম্বার সাক্ষী। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। ঘটনার কিছুই জানি না। পুলিশ রাত ৩টার দিকে ডেকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। ওখানে কোনো জিহাদি বই বা আসামিদের সঙ্গে পুলিশের গোলাগুলি দেখিনি। শুধু একজনকে গুলিবিদ্ধ দেখছিলাম।’ আরেক সাক্ষী মাহমুদ হক লাভলু বলেন, ‘আপনাদের কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম আমি এই মামলার সাক্ষী। সাক্ষী হলেতো পুলিশ ডাকবে, নোটিশ করবে। এসবের কিছুইতো জানি না’ অন্য কাউকে না করে আপনাকে কেন সাক্ষী বানাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মাহমুদ বলেন, ‘ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম, এজন্য হয়ত সাক্ষী করছে। তবে সাক্ষীর বিষয়ে কিছুই জানি না। অথচ পুলিশ এজাহারে লিখেছে, মাহমুদ এবং শামসুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের সামনেই রামদা, লোহার রড ও বোমার অংশবিশেষ উদ্ধার করা হয়। আরেক সাক্ষী মমীন গাজীকেও দেখানো হয়, সেদিন মধ্যরাতে তিনি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ ক্ষেত্রেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি বলেন, ‘আমি সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে আজ জানলাম। আমি এসবের কিছু জানি না।’ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য রুহুল আমিনকে গুলি করে পঙ্গু বানানোর পর সেটি ধামাচাপা দেয়ার এই কৌশল ধোপে টিকবে না জেনেও পুলিশ মিথ্যা নাটক সাজিয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, মামলায় নিরপেক্ষ সাক্ষীর ১০ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা, যাদের অনেকেই এখন পলাতক। কথিত বন্দুকযুদ্ধের নামে স্বার্থসিদ্ধির মিছিল ঘিরে ধরেছিল পুরো সাতক্ষীরা জেলাকে। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে শুরু হওয়া এই ঘটনাগুলো এতটাই ব্যাপক আকার ধারণ করে যে, সেখানে এক ধরনের ত্রাসের রাজত্ব চলছিল। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালে সাতক্ষীরায় প্রায় শতাধিক বন্দুকযুদ্ধে পা হারানোর ঘটনা অন্তত ৫০টি। যাদের টার্গেট করে পায়ে গুলি করা হতো। পরে হাসপাতালে নেয়া হলেও যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হতো না। বিচারবহির্ভূত এমন কর্মকাণ্ড তৎকালীন জেলা প্রশাসন জানলেও কোনো টুঁ শব্দ করেনি। মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে, এসব ঘটনায় উল্টো উৎসাহ যুগিয়েছে তৎকালীন জেলা প্রশাসন। সেসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুলি করার আগে পা অবশ করার জন্য বিশেষ ধরনের স্প্রে ব্যবহার করতো বলে ভুক্তভোগীদের অনেকেই জানিয়েছেন। এই যেমন আব্দুল মজিদ সরদার, ১০ বছর ধরে পঙ্গু জীবন বয়ে বেড়াচ্ছেন। বর্তমানে তিনি কলারোয়া পৌর যুবকের বলেন, ‘ওই সময় আমি ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। গাড়ি বহরে হামলা মামলায় আমাকে মিথ্যা আসামি করে পুলিশ। পরে পালিয়ে থাকা অবস্থায় যশোরের শার্শা থেকে গ্রেপ্তার করে।’ মজিদ বলেন, ‘ওই দিন ছিল ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। গ্রেপ্তারের পর আমাকে নেয়া হয় অজ্ঞাত স্থানে। ওই দিন রাতেই একটি মাইক্রোবাসে কয়েকজন সাদা পোশাকধারীর হাতে তুলে দেয় শার্শা থানা পুলিশ। পরে কলারোয়ার কাজীরহাট কলেজের পাশে নিয়ে পায়ে গুলি করে।’ সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘প্রথমে চোখ ও হাত বাঁধে, এরপর গাড়ি থেকে নামায়। পরে পায়ে এক ধরনের স্প্রে করল; একটু পরেই ফাঁকা গুলি, মাটিতে গুলি করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজায়; এক পর্যায়ে পায়ে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে।’ আব্দুল মজিদের মামলাতেও সেই একই নাটক। বন্দুকযুদ্ধে পঙ্গু করে দেয়ার পর সাজানো মামলায় ১৫ জনকে সাক্ষী বানায় পুলিশ। এর মধ্যে নিরপেক্ষ সাক্ষী ৫ জন। নিরপেক্ষ সাক্ষীদের প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মামলায় স্বাক্ষর নেয়া হয়েছে বলে জানান তারা। সাক্ষী আব্দুল খালেক বলেন, ‘এটা সাজানো ঘটনা, আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানি না অথচ সাক্ষী করছে। আমার চাচা গ্রাম পুলিশ ইখলাছুর, আমাকে কিছু না জানিয়ে স্বাক্ষর নেয়। এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে আমার বাড়ি ৪/৫ কিলোমিটার দূরে, এত রাতে সেখানে যাবো কীভাবে? আমি জজ সাহেবের সামনেও একই কথা বলেছি, যে সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ গ্রাম পুলিশ ইখলাছুর ও রেজাউল ইসলামকেও সাক্ষী করে পুলিশ। তারা জানান, ‘মাঝে-মধ্যে হাজিরা দিতে আমাদের থানায় ডাকে পুলিশ। বিভিন্ন সময় আমাদের থেকে স্বাক্ষরও নেয়া হয়। এ ঘটনাতেও ঠিক ওইভাবে স্বাক্ষর নিয়েছে। তবে সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে কিছুই জানতাম না। একদিন নোটিশ আসার পর জানতে পারি আমাদের সাক্ষী করা হয়েছে।’ ইখলাছুর বলেন, ‘ঘটনাস্থল আমার বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে, এত রাতে সেখানে আমি থাকবো কীভাবে? জজের সামনে আমরা সত্যটাই বলেছি।’ বাকি দুই সাক্ষীর বক্তব্যও একই রকম; তারাও সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে জানতেন না বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ভুক্তভোগীদের অনেকেই ন্যায়বিচারের জন্য সোচ্চার হয়েছেন। এরই মধ্যে জেলার তৎকালীন পুলিশ সুপার মঞ্জুরুল কবির, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শামীম হাসান, হোসাইন শওকত ও ইকবাল হোসেনসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছেন। গুম কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী নূর খান এসব ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি সেসময় অনেক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। অনেককে কথিত ক্রসফায়ারে মেরে ফেলা হয়েছে, অনেকের পায়ে গুলি করে পঙ্গু করে দেয়া হয়েছে। শুধু যে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের তা নয়, অনেক সাধারণ মানুষকেও গুলি করা হয়েছে। তৎকালীন জেলা পুলিশের অনেকেই এখনো বহাল তবিয়তে, কেউ হয়ত অবসরে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো উদ্যোগ দেখি না। এ ঘটনায় তৎকালীন জেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও দায় এড়াতে পারে না।’ সচরাচর মামলার নথিতে বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তার ফোন নম্বর দেয়া থাকে। তবে সাতক্ষীরার নাশকতার এই মামলাগুলোতে ফোন নম্বর নেই। সেটিও বিশেষ কারণে। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে পুলিশেরই একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, অনেকটা নিজেদের আড়াল করতেই এমন কৌশল। যে কারণে মামলা সংশ্লিষ্ট তৎকালীন কোনো কর্মকর্তার বক্তব্যও নেয়া সম্ভব হয়নি। ক্যাপিংয়ের মতো নির্মম এসব ঘটনায় আইনি পদক্ষেপ কী হতে পারে? জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ইতোমধ্যে সাতক্ষীরায় এমন ধরপাকড় ও নী ক্যাপিং নিয়ে আমাদের তদন্ত সংস্থার কাছে অভিযোগ এসেছে, অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। শুধু পঙ্গু কার নয় কথিত বন্দুকযুদ্ধে খুন, অনেকের বাড়িঘরে আগুন, বুলডোজার দিয়ে বাড়ি ভাঙা, ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর অভিযোগও আছে। এই মামলাগুলো ট্রাইব্যুনাল আলাদাভাবে গুরুত্ব দিয়ে বিচার কার্যক্রম শুরু করবে।’ |