![]() আরব বিশ্বের বিভক্তি ও ভবিষ্যৎ প্রভাব
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের বিশাল জ্বালানি সম্পদ নিয়ে একটি স্বাধীন আরব জ্বালানি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে পারে, যা আঞ্চলিক অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবে এবং পশ্চিমা বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাবে। একইসঙ্গে কৃষি প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং আন্তঃআরব বাণিজ্য এ অঞ্চলকে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমাতে সহায়ক হতে পারে, যা দীর্ঘকাল ধরে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্বলতার একটি উৎস। এবার যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্য সফরে বের হয়েছেন, তখন তিনি আগের চেনা জায়গাটা আর আগের মতো নেই দেখে অবাক হচ্ছেন-কারণ, এবার তিনি যে মধ্যপ্রাচ্য দেখছেন, সেটা তাঁর প্রথম প্রেসিডেন্ট থাকার সময়কার মধ্যপ্রাচ্য থেকে অনেকটাই বদলে গেছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালানোর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন হলো-ইসরায়েলের একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভাব। আরব বিশ্ব এখনো গভীর বিশৃঙ্খলার মধ্যে রয়েছে। অন্তত পাঁচটি আরব দেশ নিজেদের দেশের ভেতরে গভীর সংকটে পড়েছে। এর ফলে তারা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়েছে বা রাষ্ট্র হিসেবে ব্যর্থতার পথে রয়েছে। এই ক্ষমতাশূন্যতার মধ্যে যে বিকল্প শক্তিকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তা হচ্ছে: পারস্য উপসাগরের ধনী দেশগুলো-বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কাতারের কথা বলা যায়। আরব বসন্তে তারা তুলনামূলকভাবে অক্ষত থেকেছে এবং তেল-গ্যাস ও সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের কারণে তারা শক্তিশালী ও স্থিতিশীল কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষ করে সৌদি আরব এখন মধ্যপ্রাচ্যে বড় ভূমিকা নিতে শুরু করেছে। এবং আরব নয়,এমন তিনটি দেশ ইসরায়েল, তুরস্ক ও ইরানের কথা বলা যায়। এই তিন দেশই এমন শক্তি, যাদের নিজেদের সীমান্তের বাইরে সামরিক প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা আছে। তারা সবাই কোনো না কোনো সময় অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার মুখোমুখি হলেও শেষ পর্যন্ত নিজেদের স্থিতিশীলতা ধরে রেখেছে। এদের রয়েছে বড় অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, নিজস্ব অস্ত্র তৈরির ক্ষমতা এবং উন্নত নিরাপত্তা, সামরিক ও গোয়েন্দা শক্তি। এই তিন দেশের মধ্যে ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য এবং সিরিয়ায় নতুনভাবে প্রভাবশালী এক শক্তি হয়ে উঠেছে। আর ইরান, যদিও তার মিত্রগোষ্ঠী হামাস ও হিজবুল্লাহকে ইসরায়েল ধ্বংস করে দিয়েছে, তবু এখনো যথেষ্ট প্রভাবশালী। বিশেষ করে তার পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইরান আজও ইসরায়েল ও আমেরিকার নীতিনির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আরব নয়-এমন রাষ্ট্রকে আরব দেশগুলো সন্দেহ ও অবিশ্বাসের চোখে দেখে; কিন্তু কেউই তাদের সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক করতে চায় না। এই তিন দেশের মধ্যে পরস্পরের উদ্দেশ্য ও স্বার্থ নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তারা একে অন্যকে প্রতিহতও করছে। কিন্তু তারা মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতায় স্থায়ীভাবে থেকে যাবে বলেই মনে হচ্ছে। আরব বিশ্বের বিভক্তির কারণে ভবিষ্যতে এদের প্রভাব আরও বাড়বে।২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পরপরই মনে হচ্ছিল ফিলিস্তিন সমস্যা আবারও মধ্যপ্রাচ্য ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। যাঁরা বলছিলেন ফিলিস্তিন ইস্যু গুরুত্ব হারিয়েছে, তাঁরা তখন গাজার বেসামরিক মানুষের প্রতি বিশ্বজুড়ে সহানুভূতি ও সমর্থনের জোয়ার দেখে চুপ হয়ে গিয়েছিলেন। ইসরায়েল যখন হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালায়, তখন যে মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়, সেটাই এই সহানুভূতির মূল কারণ ছিল। জাতিসংঘ যুদ্ধ থামাতে বলেছে এবং এ নিয়ে বেশ কিছু প্রস্তাবও পাস করেছে। পৃথিবীর অনেক দেশ ও মানুষ ইসরায়েলকে এবং এই যুদ্ধকে তীব্রভাবে নিন্দা করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে) খতিয়ে দেখছেন ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা করছে কি না। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ও হামাসের এক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। অবশ্য তিনি মারা গেছেন। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি জাতীয় আন্দোলনও সম্পূর্ণ বিভক্ত ও দুর্বল। এখন ফিলিস্তিনিদের সামনে দুটি অপছন্দনীয় বিকল্প হচ্ছে; একদিকে হামাস, অন্যদিকে বহুদিন ধরে ক্ষমতায় থাকা ও কার্যত নিষ্ক্রিয় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ক্ষীণ। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ট্রাম্প প্রশাসন কীভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে এটা স্পষ্ট, তারা ইসরায়েলপন্থী অবস্থান নিয়েছে। ট্রাম্প বলেছিলেন, গাজাকে রিভিয়ারার মতো পর্যটনকেন্দ্র বানানো যায়। তিনি গাজা থেকে জিম্মি মুক্ত করতে একজন বিশেষ দূত নিয়োগ করেছেন; কিন্তু যুদ্ধ-পরবর্তী গাজা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা দেননি। বরং গাজা পরিস্থিতি ইসরায়েলের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, যারা আবারও সেখানে সামরিক অভিযান শুরু করেছে। ট্রাম্প লেবানন ও সিরিয়া সীমান্তে ইসরায়েলের আগ্রাসী নিরাপত্তানীতিও মেনে নিয়েছেন এবং পশ্চিম তীরে দখলদারি ও বসতি স্থাপনেও সমর্থন দিয়েছেন। তবে ট্রাম্প একেবারে অনিশ্চিত চরিত্র। নেতানিয়াহুর পাশে বসেই তিনি ঘোষণা করেছেন, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে আলোচনা শুরু করবে। যদিও নেতানিয়াহু চান ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সমাধান হোক সামরিকভাবে। কিন্তু যদি এই আলোচনায় অগ্রগতি হয়, কিংবা ইসরায়েল-সৌদি সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতি ট্রাম্পের আগ্রহ বাড়ে, তাহলে তাকেও গাজার যুদ্ধ-পরবর্তী পরিকল্পনা ও ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে হতে পারে। এই সম্ভাবনাগুলো ইতিমধ্যে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর মধ্যে টানাপোড়েন তৈরি করছে। এবার মধ্যপ্রাচ্য সফরে ট্রাম্প ইসরায়েল যাবেন না, আর নেতানিয়াহুও অনমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন। কিন্তু যেহেতু রিপাবলিকান দলে ট্রাম্পের নিয়ন্ত্রণ একচেটিয়া, তাই হোয়াইট হাউস যদি ইসরায়েলের বিপক্ষে কিছু নীতির প্রস্তাব দেয়, তাহলে নেতানিয়াহুর হাতে বিকল্প তেমন থাকবে না। আর ট্রাম্প কিছু চাইলে তা পেতে চাপ প্রয়োগ করতে তিনি কুণ্ঠাবোধ করেন না-এটা বিশ্বের সব মিত্রদেশই ইতিমধ্যে জেনে গেছে। তুরস্ক, ইরান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া-এই দেশগুলো তুলনামূলক ভাবে সরব থেকেছে। তুরস্ক কূটনৈতিকভাবে সক্রিয় থেকেছে, ইরান রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দিয়েছে, মালয়েশিয়া- ইন্দোনেশিয়া কঠোর নিন্দা জানিয়েছে। বাংলাদেশও জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। আরব রাষ্ট্রগুলোর সাথে এই মুসলিম দেশের তুলনা করলে স্পষ্ট হয়, আরব নেতাদের অবস্থান অনেক বেশি নিষ্ক্রিয় এবং বাস্তবধর্মী কম, বরং পশ্চিমা প্রভাবপ্রবণ।আরব রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা অনেক সময় আন্তর্জাতিক চাপ নির্ভর করে। পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য ও বিনিয়োগ পেতে তারা অনেক সময় মানবিক নীতির চেয়ে কূটনৈতিক লাভ-ক্ষতিকে প্রাধান্য দেয়। তবে এই কৌশল দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্যই আত্মঘাতী হতে পারে। আরব বিশ্ব ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিন আন্দোলনের অন্যতম অভিভাবক ছিল। কিন্তু আজ সেই অভিভাবকতা হ্রাস পেয়েছে। এই নীরবতা মুসলিম উম্মাহর ঐক্যে ভাঙন ধরাচ্ছে এবং মুসলমানদের রাজনৈতিক দুর্বলতা তুলে ধরছে। তা ছাড়া, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মুসলিম বিশ্বের স্বার্থ রক্ষা করা আরও কঠিন হয়ে পড়ছে।ফিলিস্তিন ইস্যু শুধুমাত্র একটি ভৌগোলিক-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নয়, এটি একটি ন্যায়-অন্যায়, মানবতা ও নিপীড়নের লড়াই। আরব নেতাদের নীরবতা এ নিপীড়নকে বৈধতা দিচ্ছে, যা শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, গোটা মুসলিম বিশ্বের জন্যই হুমকি। এই অবস্থান পরিবর্তনের জন্য দরকার আরব জনগণের শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাপ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কার্যকর ভূমিকা এবং মুসলিম বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ কূটনীতি। নৈতিক অবস্থান স্পষ্ট না করলে আজ যারা নীরব, কাল তারা নিজেরাই নিপীড়নের শিকার হতে পারেন।আরব নেতারা যেভাবে নীরব থেকেছেন, আরব জনগণ কিন্তু সেভাবে চুপ করে থাকেনি। জর্ডান, মিশর, মরক্কো, ইয়েমেন, লেবাননসহ বহু দেশে হাজার হাজার মানুষ ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভে অংশ নিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদের ঝড় বইছে। অনেক ক্ষেত্রে, এসব বিক্ষোভ সরকারের বিরুদ্ধে রূপ নিচ্ছে-এটা বুঝিয়ে দেয় যে, জনগণের মনোভাব এবং শাসকদের অবস্থান এক নয়। কাজেই আসন্ন আরব শীর্ষ সম্মেলন কেবল একটি কূটনৈতিক সমাবেশ নয়, আরব নেতারা এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম কিনা, এটি তার একটি পরীক্ষা। এ অঞ্চলে প্রয়োজনীয় সম্পদ, কৌশলগত সুবিধা এবং ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রয়েছে, যাতে এটি একটি একক ও প্রভাবশালী ব্লক হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। তবে এটি কেবল তখনই অর্জিত হবে, যখন নেতারা সমষ্টিগত স্বার্থকে ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষার উপরে অগ্রাধিকার দেবেন, শূন্য বিবৃতির পরিবর্তে নির্ধারক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করবেন এবং এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করবেন, যা এ অঞ্চলের সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে সুরক্ষিত করবে। একটি বিভক্ত আরব বিশ্ব হলো একটি দুর্বল আরব বিশ্ব। ঐক্য, কৌশল ও সক্রিয় হওয়ার সময় এখনই। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |