![]() ঈদের আগেই ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাগি’ আসামি ধরার ছক
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() বিশেষ করে নিজেদের অপরাধ সাম্রাজ্য ধরে রাখতে জড়াচ্ছে নতুন নতুন অপরাধে। চাঁদাবাজি, ব্যবসার ভাগ ও এলাকা দখলে নিতে নিজেদের শ্যুটার বাহিনী দিয়ে খুনোখুনিতেও জড়াচ্ছে তারা। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও তাদের ধরতে তৎপর। ঈদের আগেই কীভাবে এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আনা যায় সে ছক কষছেন তারা। গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা যায়, সামনে ঈদুল আজহা। ঈদ কেন্দ্র করে সারাদেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে রাখতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের দাগি আসামিদের ধরতে নির্দেশনা রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর। যেখানেই আত্মগোপনে থাকুক না কেন তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ চলছে। সবশেষ রাজধানীর মধ্যবাড্ডায় গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও ডিশ ব্যবসায়ী কামরুল আহসান সাধনকে (৫৫) গুলি করে হত্যার ঘটনায় দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রুপের নাম আসায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের ভয়ঙ্কর কার্যক্রম নতুন করে চিন্তায় ফেলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। একই সঙ্গে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোর-ছিনতাইকারী-ডাকাতসহ সব ধরনের পেশাদার অপরাধীরা। পাড়া-মহল্লায় দিচ্ছে সশস্ত্র মহড়া। প্রতিদিনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে কুপিয়ে ও গুলি করে ছিনতাই এবং নির্মমভাবে হত্যার মতো নির্মম ঘটনা। এতে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটার পাশাপাশি জনমনে সৃষ্টি হয়েছে আতংক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারামুক্তির পর পুলিশ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারি করার কথা বললেও কাজের কাজ কিছুই করা হয়নি। উলটো পুরোনো সহযোগী, জেল পলাতক আসামি ও কিশোর গ্যাং সদস্যদের দলে ভিড়িয়ে এবং জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়া অস্ত্র সংগ্রহ করে শক্তি সঞ্চয় করেছে তারা। পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার সুযোগ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডসহ পেশাদার সন্ত্রাসীরা। এখনই লাগাম টানা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে এটি আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। পুলিশের নজরদারি দুর্বলতায় বেপরোয়া আন্ডারওয়ার্ল্ড সন্ত্রাসীরা পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর থেকেই আন্দোলনের নগরীতে পরিণত হয়েছে ঢাকা। প্রতিদিনই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আন্দোলনকারীদের দখলে চলে যাচ্ছে। এসব ঘটনা থেকে যাতে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হচ্ছে পুলিশকে। অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েনের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রাখতে হচ্ছে। শুধু আন্দোলনই নয়, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ঝটিকা মিছিল ও অপতৎপরতা রুখতে বাড়তি চাপ রয়েছে পুলিশের ওপর। এছাড়াও জুলাই আন্দোলনে হামলায় অংশ নেওয়া পতিত সরকারের দোসরকে গ্রেফতারেও পুলিশ সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর এতে কমেছে চুরি-ছিনতাই-ডাকাতির মতো অপরাধীদের ওপর নজরদারি। পুলিশের এ নজরদারি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের অপরাধীরাও। ডিএমপির একটি সূত্র বলছে, আগে যে অতিরিক্ত ফোর্স অপরাধীদের নজরদারি করতো, আন্দোলন সামলে তাদের আর সেদিকে নজর দেওয়ার সময় থাকে না। ফলে ঘটনা ঘটার পর দোষীদের আইনের আওতায় আনা গেলেও আগেই দমন করা সম্ভব হচ্ছে না। অথচ পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের নামে প্রতিদিনই গ্রেফতার হচ্ছে হাজারেরও বেশি অপরাধী। গত কয়েক মাসে যত অপরাধ পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, গত এপ্রিলে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে ১৬ হাজার ৩৬৮টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৩৩৬টি। এছাড়া ডাকাতির ৪৬, দস্যুতার ১৪৯, অপহরণের ৮৮টি ও ৭১৫টি চুরির মামলা। মার্চ মাসে সারা দেশে বিভিন্ন অপরাধে ১৬ হাজার ২৪০টি মামলা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশে মামলা হয়েছে ১৩ হাজার ২টি। গত জানুয়ারি মাসে ২৯৪টি, ফেব্রুয়ারিতে ৩০০টি, মার্চে ৩১৬টি ও এপ্রিল মাসে ৩৩৬টি হত্যার ঘটনায় মামলা হয়। এছাড়াও এ চার মাসে চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭৭৫টি। ডিএমপি সূত্রে জানা যায়, নভেম্বর থেকে এপ্রিল এ ৬ মাসে মহানগরীতে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৩৯টি, ডাকাতির ঘটনায় মামলা হয়েছে ৩৬টি, ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা হয়েছে ২৪৩টি ও চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ২৮টি। জামিনে বেরিয়েই খুনোখুনিতে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর একে একে রাজধানীর ২৭ দাগি সন্ত্রাসী জামিনে বেরিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসু, শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, ফ্রিডম সোহেল, হাবিবুর রহমান তাজ, মিরপুরের কিলার আব্বাস ওরফে আব্বাস আলী, তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগের সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন, শাহাদত হোসেন, মুক্তার, খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন, সুব্রত বাইন ও মুসা শিকদার ওরফে সুমন শিকদার অন্যতম। সুব্রত বাইন গ্রেফতার এদের মধ্যে ২৭ মে ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালীশংকরপুর এলাকায় ৩ ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ ওরফে আবু রাসেল মাসুদকে আটক করে সেনাবাহিনী। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকা থেকে সুব্রত বাইনের অপর দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত এবং শরীফকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে ৫টি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগজিন, ৫৩ রাউন্ড অ্যামোনিশন এবং একটি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়। জামিনে বের হওয়ার পর তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর অন্যতম এবং সেভেন স্টার গ্রুপের দুই সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের এ সুসংগঠিত হওয়াই বলে দেয় কোনো শীর্ষ সন্ত্রাসী বসে নেই। সবাই আধিপত্য বিস্তার করতে নতুন ও পুরোনো সহযোগী দলে ভিড়িয়ে আধিপত্যের লড়াইয়ের দিকে ধাবিত হচ্ছে। গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ অগাস্ট সুব্রত বাইন কারাগার থেকে মুক্তি পান বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়। ছাড়া পেয়ে আবারও আগের মতো তৎপরতা শুরু করেন তিনি। আর মোল্লা মাসুদ মুক্তির পর ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজার এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। এরপরও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেনি। সবশেষ ২৭ মে বিকেলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মোহাম্মদপুরের কিশোর গ্যাং গ্রুপের মদতদাতা শীর্ষ সন্ত্রাসী এক্সেল বাবুসহ চারজনকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনী। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্রে জানা যায়, কথিত বিএনপি নেতা এক্সেল বাবু কবজি কাটা গ্রুপের প্রধান আনোয়ারের আশ্রয়দাতা হিসেবে পরিচিত। যা বলছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসীরা জামিনে বের হওয়ার পর পুলিশের পক্ষ থেকে যে নজরদারির কথা বলা হয়েছিল সেটির কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পুলিশের পক্ষে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নজরদারিতে রাখা কতটা সম্ভব সেটিও ভেবে দেখা উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে পুলিশ এ ধরনের নজরদারি পারবে না। এ সুযোগ নিয়েই ভয়ার্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে সন্ত্রাসীরা।’ অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘অপরাধীরা সব সময় অপরাধ সংগঠনের জন্য সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। এখন যেহেতু রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে একটি নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা বিরাজ করছে, এ সুযোগটাই নিচ্ছে আন্ডারওয়ার্ল্ডসহ অন্য অপরাধীরা। সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ স্থিতিশীল হলে অপরাধগুলো কমে যাবে।’ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যা বলছেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘জনমনে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে স্বস্তি আনতে আমাদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। অপরাধের রেড জোন চিহ্নিত করে টহল বাড়ানো হয়েছে। প্রতিদিন ৫০ থানার ২৫০টি টহল টিম ও ৭০০ মোবাইল টিম টহল দিচ্ছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পাওয়া চোর-ছিনতাইকারীদের তালিকা প্রত্যেক বিভাগের ডিসিদের কাছে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি, বর্তমানে বিভিন্ন এলাকায় তৎপর অপরাধীরা দ্রুতই আইনের আওতায় আসবে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান অপরাধ নিয়ন্ত্রণে মাল্টিডাইমেনশন অ্যাকশন পরিচালনা করছে ডিবি পুলিশ। চোর-ছিনতাইকারী, জাল টাকার কারবারি, অনলাইন প্রতারক, ভেজালবিরোধীসহ সব ধরনের অপরাধই এ কার্যক্রমের আওতায় আছে।’ আন্ডারওয়ার্ল্ড বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো অপরাধীরই অপরাধ করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই। যতগুলো আলোচিত ঘটনা ঘটেছে সবই ডিটেক্ট করে জড়িতদের গ্রেফতার করা হয়েছে।’ পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (ক্রাইম) ড. মো. আশরাফুর রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনী সুব্রত বাইনসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করেছে। এ বিষয়টি চলমান। আশা করছি ঈদের আগেই শীর্ষ সন্ত্রাসী যারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এর মাধ্যমে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কার্যক্রম থাকবে না। পাশাপাশি পুলিশি পেট্রোলসহ টহল কার্যক্রম চলমান থাকবে।’ ঈদ উপলক্ষে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি আন্ডার কন্ট্রোল। ঈদের আগে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের ধরতে পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে।’ |