![]() মানবিক করিডর ইস্যুতে ‘ব্যাকফুটে’ সরকার
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করিডর ইস্যু সরকারকে চাপে ফেলেছে। এ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলসহ দেশের সচেতন নাগরিক ক্রমাগত সমালোচনা করছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা করিডর ইস্যুতে বারবার নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সেজন্য এ আলোচনা থামাতে সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। খোদ সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান ‘করিডর’ ইস্যুতে বিশেষ ব্রিফ করে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছেন। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন সরকারের অবস্থান। তবে এ বিষয়ে সমালোচনা থামবে বলে মনে করছেন না সংশ্লিষ্টরা। বরং করিডর ইস্যু সরকারের জন্য কাল হওয়ার ‘শঙ্কা’ দেখছেন কেউ কেউ। সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, মানবিক করিডর নিয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার তথ্য সঠিক ছিল। কিন্তু বিষয়টি যে সরকারকে চাপে ফেলবে সেটি নীতিনির্ধারকরা হয়ত ভাবেনি। করিডর নিয়ে সমালোচনা থামছে না। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি ক্রমাগত বক্তব্য দিয়েই যাচ্ছে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও বক্তব্যে করিডর ইস্যু টেনে সমালোচনা করছেন। সরকারও তার অবস্থান তুলে ধরেছে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বিশেষ ব্রিফ করেছেন। কিন্তু উনার বক্তব্যের পরও এ ইস্যুতে বক্তব্য এসেছে। বুধবার ঢাকায় করিডর নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে করিডর স্থাপনের কথা ‘গুজব এবং সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’। করিডর নিয়ে আমাদের সঙ্গে কারও কোনো কথা হয়নি, হবেও না। নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেন, করিডরের বিষয়টা বুঝতে হবে। এটা হচ্ছে একটা ইমারজেন্সি সময়ে দুর্যোগপূর্ণ জায়গা থেকে মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা। আমরা এখানে কাউকে সরাচ্ছি না। যেহেতু আরাকানে সাহায্য সহযোগিতা অন্যান্য সাপ্লাই রুট দিয়ে সম্ভব হচ্ছে না, জাতিসংঘ আমাদের এইটুকুই বললো যে, কাছেই যেহেতু বর্ডার, তাদের সাহায্য করতে, যাতে ত্রাণগুলো ওপারে নিয়ে যেতে পারে। তিনি বলেন, জাতিসংঘ রাখাইনে তার নিজস্ব সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছাবে। আপনারা জাতিসংঘকে জিজ্ঞেস করেন, প্রমাণ পাবেন। আমরা করিডর নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও ধরনের কথা বলিনি এবং বলব না। আরাকানের যে অবস্থা তাতে করিডরের কোনও প্রয়োজন নেই। করিডর নিয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টার বক্তব্যের ঘণ্টা দুয়েক পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। সেখানে করিডর নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েন উপদেষ্টা। তবে তিনি সাফ জানিয়ে দেন, করিডর ইস্যুতে কোনো মন্তব্য করবেন না। এরপর করিডর প্রসঙ্গে কথা বলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে অফিসার্স অ্যাড্রেসে দেওয়া বক্তব্যে সেনাপ্রধান বলেন, রাখাইন রাজ্যে মানবিক করিডর বিষয়ে সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকার থেকেই আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই হতে হবে। এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। যা করার জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করেই করতে হবে। যা-ই করা হোক না কেন, পলিটিক্যাল কনসেনসাসের (রাজনৈতিক ঐকমত্য) মাধ্যমে সেটা হতে হবে। করিডর নিয়ে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বক্তব্য আসার পর থেকে এখন অবদি সরকারের কঠোর সমালোচনা করে যাচ্ছে বিএনপি। দলটির নেতারা প্রতিনিয়ত অন্য বিষয়ের সঙ্গে করিডর ইস্যু জুড়ে দিয়ে সরকারের সমালোচনা করে যাচ্ছে। গত ১৮ মে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান করিডর ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করেন। তিনি বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে করিডর প্রদান কিংবা বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশির হাতে তুলে দেওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য বলে মনে হচ্ছে। আমরা আবারও স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই, করিডর কিংবা বন্দর দেওয়া না–দেওয়ার সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়, এই সিদ্ধান্ত নেবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ বা জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার। শুধু বিএনপি নয়, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলনসহ ইসলামী দলগুলো এবং অন্যদিকে বামপন্থি ও উদারপন্থি দলগুলো সরকারের সমালোচনা করছে। চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ ঢাকা পোস্ট বলেন, আগে একরকম বলেছেন, এখন অন্য রকম বলছেন! একবার বলছেন করিডর, একবার বলছেন চ্যানেল। করিডর আর চ্যানেলের মধ্যে পার্থক্য কী, সেটা বোঝা মুশকিল। এখন বলছে কারও সঙ্গে কথা হয়নি। এর আগে বলেছে, কথা হয়েছে। সরকার যে বারবার তাদের কথা ঘুরাচ্ছে, এটা কীসের লক্ষণ? তাদের একটা সিদ্ধান্তহীনতার লক্ষণ, তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে ঐকমত্য নাই। যদি ঐকমত্য থাকত তাহলে তো এতদিনে করে ফেলত। সরকারের মধ্যে এ ব্যাপারে ভিন্ন মত আছে। ফয়েজ আহমেদ বলেন, সরকার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে বা সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। এ ছাড়া, তারা অনেক সময় নিয়েছে এটা বুঝতে যে সাধারণ মানুষ চায় না। বাংলাদেশের মানুষ এটা চায় না। জোর করে চাপিয়ে দিলেই তো হবে না। কিন্তু চাপিয়ে দেওয়ার যে একটা চেষ্টা হয়েছিল সেটা মোটামুটি এখন সবাই বুঝতে পারছে। চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় এখন সরে আসা হয়েছে, এটা মানুষ বুঝতে পেরেছে। গত ২৭ এপ্রিল রাখাইনে মানবিক করিডর দেওয়া নিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছিলেন, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটা হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ) হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্ত রয়েছে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এমন বক্তব্যের পর রাখাইনে করিডর দেওয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা ও সমালোচনা শুরু হয়। সামনে আসে নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়টি। আর সেই আলোচনা এখনো থামেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, একটা অরাজনৈতিক সরকার কীভাবে রাজনৈতিক দলগুলোকে চ্যালেঞ্জ করে তার প্রভাব ধরে রাখতে চায়। এটা কি সম্ভব? অন্তর্বর্তী সরকার কতগুলো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল যার মধ্যে করিডর একটি। তাদের বোঝা উচিত ছিল বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার তাদের নেই। তাদের কাজ যেটা সেটাতে বরং মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। প্রসঙ্গত, চলতি বছরের মার্চে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সফরকালে তিনি রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠাতে বাংলাদেশকে চ্যানেল হিসেবে ব্যবহারের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেন। |