![]() অতিষ্ঠ রাজধানীবাসী: ‘অপ্রতিরোধ্য’ মশার পেটে ১৫০ কোটি টাকা, ফলাফল শূন্য
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রায় ১৪৬৩ দশমিক ৬০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ রাজধানী ঢাকা শহর। এখানে বাস করেন নানা শ্রেণি ও পেশার প্রায় দুই কোটি মানুষ। ‘স্বপ্নগড়ার’ এ ভূমিতে প্রতিদিন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। এখানে মানুষ যেমন বাড়ছে, বাড়ছে মশাও। বসবাসরত নাগরিকদের মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। নগরবাসীর মতে, রাজধানীতে ফের মশার উপদ্রব বেড়েছে। তারা মশার অত্যাচারে রীতিমতো অতিষ্ঠ। সিটি কর্পোরেশনের লোক দেখানো কার্যক্রমে মশা কমেনি বরং বেড়েছে। ঢাকার মশা যেন এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে গেছে। গত রোববার (১৮ মে) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ পুরুষ এবং ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ নারী। গত ১ জানুয়ারি থেকে ১৮ মে পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন মোট তিন হাজার ৪৫২ জন। এর মধ্যে ৫৯ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক ১ শতাংশ নারী। যদিও মশা মারতে প্রতি বছর বাজেটে শত কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় শহরজুড়ে যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এডিস মশার প্রজননস্থল এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগও নেয় সিটি কর্পোরেশন। কিন্তু সবকিছু ব্যর্থ করে দিয়ে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল মশা। মশা মারতে সিটি কর্পোরেশন এক সময় রাজধানীর বিভিন্ন খাল, নালা, ড্রেনসহ বিভিন্ন জলাশয়ে ব্যাঙ ছাড়ে। জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য কাজে লাগিয়ে ব্যাঙগুলো পানিতে ভাসতে থাকা মশার লার্ভা খেয়ে ফেলবে। সে লক্ষ্যে ছাড়া হয়েছিল হাঁসও। ধারণা করা হয়েছিল, সেসব স্থানে মশা আর বংশবিস্তার করতে পারবে না। এছাড়া জিঙ্গেল বাজিয়েও মশা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়। অথচ দুই সিটির এত সব উদ্যোগ ভেস্তে যায়। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ নগরবাসী রাজধানীর বনশ্রী এলাকার বাসিন্দা শারমিন আক্তার বলেন, বছরের পুরো সময় আমাদের এলাকায় মশার উপদ্রব থাকে। ডেঙ্গুর মৌসুম সামনে, যে কারণে আমাদের ভয় আরও বেশি। হঠাৎ করে মশার উপদ্রব খুব বেড়েছে। বাসায় ছোট বাচ্চা আছে, যে কারণে সবসময় কয়েল বা অ্যারোসল ব্যবহার করতে পারি না। কিন্তু মশা তো ছাড়ে না, সারাদিন কামড়াতে থাকে। ফলে বাধ্য হয়ে দিনের বেলায়ও মশারি টাঙিয়ে রাখতে হয়। তার অভিযোগ, মশা মারতে সিটি কর্পোরেশনের এত এত পদক্ষেপ, কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। সারাদিন আমাদের মশার কামড় খেতে হয়। আমার মনে হয়, সিটি কর্পোরেশন লোক দেখানো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। যে কারণে মশার উপদ্রব থেকে মুক্তি মিলছে না রাজধানীবাসীর। রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বেসরকারি চাকরিজীবী আলমগীর হোসেন বলেন, ভাড়া বাসার পাঁচ তলায় থাকি। সেখানেও মশার উপস্থিতির কমতি নেই। ইদানীং মশার উপদ্রব আরও বেড়েছে। গত ডেঙ্গু মৌসুমে আশপাশের বাসার অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন। এ কারণে এবারও আমরা ভয়ে আছি। সিটি কর্পোরেশন যদি আগে থেকে মশা নিধনের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে এবারও ডেঙ্গু ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। ‘সিটি কর্পোরেশন কাজের কাজ কিছুই করছে না’— উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মশা নিধনে তারা বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানায়। কিন্তু বাস্তবে তাদের কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল পাওয়া যায় না। মশার ওষুধ ছিটানোর লোকজনও খুব একটা চোখে দেখা যায় না। এভাবে চলতে থাকলে এবার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে ডেঙ্গু।’ একই ধরনের অভিযোগ জানিয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা সবুজ আহমেদ বলেন, ‘দিন কিংবা রাত, আমাদের এলাকায় সবসময় মশার উপদ্রব থাকে। দিনের আলোতেও ঘরে মশার কয়েল জ্বালাতে হচ্ছে। ইদানীং মশার উপদ্রব আরও বেড়েছে। অথচ মশার ওষুধ ছিটানোর কর্মীদের দেখা যায় না বললেই চলে। সপ্তাহে দু-এক দিন তাদের দেখা যায়, অথচ প্রতিদিন দুই বেলা ওষুধ ছিটানোর দায়িত্ব তাদের।’ বাজেট বাড়ে মশাও বাড়ে প্রতি বছর মশা মারতে বাজেট বাড়ায় ঢাকার উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। বাজেট বাড়লেও কমে না মশা, উল্টো মশার উৎপাত প্রতি বছরই যেন বাড়ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে মশা নিয়ন্ত্রণে প্রায় ১১০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এর মধ্যে মশা নিধনে কীটনাশক কিনতে ব্যয় ধরা হয় ৬৫ কোটি টাকা। বাকি অর্থ ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহন, ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক এবং মশা নিয়ন্ত্রণের যন্ত্রপাতি কিনতে বরাদ্দ রাখা হয়। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) বরাদ্দ রাখে ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশক কিনতেই তারা বরাদ্দ রাখে ৪০ কোটি টাকা। এছাড়া ফগার, হুইল, স্প্রে মেশিন ও পরিবহনে ব্যয় ধরে তিন কোটি ৭৫ লাখ টাকা। পাশাপাশি ব্লিচিং পাউডার ও জীবাণুনাশক কিনতে বরাদ্দ রাখে আরও ৫০ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মশা নিধনে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এত অর্থ ব্যয় করা হলেও ফলাফল শূন্য— বলছেন নগরবাসী। যা বলছেন সংশ্লিষ্টরা মশা নিয়ন্ত্রণে নিজেদের অবস্থানের কথা জানিয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘আমরা নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। আমাদের কর্মীদের কাজের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তারা নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন। বর্ষার মৌসুমকে মাথায় রেখে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা দুটি স্তরে কার্যক্রম শুরু করেছি। প্রথমটি হলো— নিয়মিত মশক নিধন ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। দ্বিতীয়টি হলো— বিশেষ মশক নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম এবং জনগণকে সম্পৃক্তকরণে জনসচেতনতামূলক র্যালি, যা পর্যায়ক্রমে ডিএসসিসির ১০টি অঞ্চলে পরিচালনা করা হবে। ইতোমধ্যে যাত্রাবাড়ী ও ধানমন্ডিতে বিশেষ অভিযান পরিচালিত হয়েছে।’ ‘আমরা যেমন আমাদের দিক থেকে কাজ করে যাচ্ছি, তেমনি নগরবাসীকেও সচেতন হতে হবে। বাসার ভেতরে, ফুলের টব, চৌবাচ্চা ও বারান্দায় জমে থাকা পানি তিন দিনের ভেতরে নিজ উদ্যোগে ফেলে দিতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশন ও নগরবাসীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এটি করতে পারলে আমরা ডেঙ্গু মোকাবিলা করতে পারব।’ ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রশাসক মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘অনেক জায়গা থেকে অভিযোগ আসছে, মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হয় না। তাই যারা কাজটি করত তাদের সঙ্গে চুক্তি আর নবায়ন করা হয়নি। মশার ওষুধ ঠিকমতো ছিটানো হচ্ছে কি না, সেটি তদারকিতে আমরা সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করার চিন্তা-ভাবনা করছি।’ ‘অন্যদিকে আমরা নগরবাসীকে বলব, আমরা আমাদের দিক থেকে কাজ করে যাচ্ছি। আপনারাও নিজ নিজ বাসা-বাড়ি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করবেন। সপ্তাহে অন্তত দুদিন যার যার বাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার করবেন। আমরা আগামীতে আরও অভিযান পরিচালনা করব। অভিযানে এডিসের লার্ভা পেলে জরিমানা করা হবে।’ সার্বিক বিষয়ে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, ‘অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং ছোট আয়তনের এ শহরে অধিক জনসংখ্যার কারণে প্রচুর পরিমাণে ছোট-বড় পাত্র তৈরি হয়, যার মধ্যে পানি জমা হয়ে মশার বংশবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়। অন্যদিকে, প্লাস্টিকের বহুল ব্যবহারের ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ধরনের প্লাস্টিকের পাত্র, যেমন- বোতল, কাপ, ব্যাগ ইত্যাদি। এসব পাত্রে বৃষ্টি হলেই কম-বেশি পানি জমা হয়। জমা হওয়া এই পানি এডিস মশার প্রজননের জন্য আদর্শ জায়গা তৈরি করে।’ ‘সার্বিক বিষয়ে গুরুত্বসহকারে সিটি কর্পোরেশনকে কাজ করতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে বিজ্ঞানভিত্তিক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে, বিশেষ করে জনসচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা খুব জরুরি।’ ১০ বছরে বরাদ্দ ৮০০ কোটি, সুফল পেয়েছে কি নগরবাসী নগরবাসীকে মশার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে গত ১০ বছরে দুই সিটি কর্পোরেশন বাজেটে বরাদ্দ রেখেছিল প্রায় ৮৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এত টাকা খরচ করেও নগরবাসীকে মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা করতে পারেনি সিটি কর্পোরেশন। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনে (ডিএনসিসি) ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১৪ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১১ কোটি ৯৫ লাখ)। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা), ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা), ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ১৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা), ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫৮ কোটি টাকা), ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭০ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫০ কোটি ৫০ লাখ টাকা), ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৫ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫১ কোটি ৫৩ লাখ) ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৭৬ কোটি টাকা (সংশোধিত বাজেট ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা), ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা (সংশোধিত বাজেট ৮৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা)। সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেটে বরাদ্দ দেওয়া হয় ১১০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে উত্তর সিটিতে গত ১০ অর্থবছরে প্রায় ৫৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থবরাদ্দ দেওয়া হয় মশক নিধনে। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মশক নিধনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেয় ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৬ কোটি টাকা, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছরে ২০ কোটি ২ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১ কোটি ২ লাখ টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৮ কোটি ৮৩ লাখ এবং সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। অর্থাৎ গত ১০ অর্থবছরে দক্ষিণ সিটিতে প্রায় ২৭০ কোটি টাকা মশক নিধনে বরাদ্দ দেওয়া হয়। |