![]() ভুয়া সাংবাদিকের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে মর্যাদা
মীর আব্দুর আলীম:
|
![]() আজকাল সাংবাদিকতার চেহারা অনেকটা পলিথিনে মোড়ানো আমের শরবতের মতো—দেখতে চকচকে, কিন্তু গন্ধেই ধরা পড়ে আসল নকল। সাংবাদিকের সংজ্ঞা যেন কেউ আর বুঝতেই চায় না। যার হাতে ক্যামেরা, যার গলায় কার্ড—সে-ই সাংবাদিক! কেউ যদি বলে, “আমি মিডিয়া”—তাহলেই তার বিশেষাধিকার! পুলিশ থেমে যায়, ট্রাফিক হ্যান্ডসালুট দেয়, আর গ্রামের মানুষ তাকে ভক্তিভরে ‘স্যার’ ডাকে। আজকাল একজন মানুষ সকালে জুতা বিক্রি করে, বিকালে বিয়ের অনুষ্ঠানে ঢুকে গলা ফাটিয়ে বলে, “লাইভ চলছে”! আর রাতে ‘জেলা প্রতিনিধি’ নাম দিয়ে ফেসবুকে নিউজ শেয়ার করে। যিনি কাল পর্যন্ত চায়ের দোকানে কাজ করতেন, আজ তার পকেটে ঝুলছে একটি রঙিন প্রেস কার্ড। কে বানালো? কিভাবে পেল? প্রশ্ন তোলার সাহস কই? সাংবাদিকতার নামে এই মঞ্চে আজ অনেকেই অভিনয় করছেন এমন এক চরিত্রে, যার পেছনে আছে চাঁদাবাজি, ব্ল্যাকমেলিং, দলীয় প্রভাব, আর অপসংস্কৃতির বীজ। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া, রাজশাহী থেকে রাঙামাটি—যেদিকে তাকাই, সেদিকেই তথাকথিত ‘মিডিয়া অফিস’। চায়ের দোকান, বিউটি পার্লার, মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টারের পাশেই ঝোলানো ব্যানার—“অফিস অফ দি ক্রাইম রিপোর্টার, জেলা প্রতিনিধি: জনাব নিজাম সাহেব”! কে তাকে নিয়োগ দিল? সে কোন পত্রিকায় কাজ করে? এগুলোর জবাব নেই, প্রয়োজনও নেই। দরকার শুধু কার্ড, ক্যামেরা আর গলা ফাটানো কিছু সংলাপ। আর এসব কার্ডের উৎস? এক শ্রেণির তথাকথিত ‘মিডিয়া মালিক’। যাদের কাছে সাংবাদিকতা ব্যবসা, সম্মান নয়। তারা প্রেস কার্ড বিক্রি করেন ঈদের অফারের মতো—“প্যাকেজ নিন, পদ পান!” টাকা যত বেশি, পদ তত বড়—ইনভেস্টিগেটিভ চিফ রিপোর্টার, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, চিফ এডিটর, এমনকি প্রেসিডেন্ট অব নিউজ। বানান ভুল থাকলেও চলে, কারণ কার্ড দেখে কেউ বানান মিলিয়ে দেখে না! এই কার্ডযুদ্ধের ফলে অনেক প্রকৃত সাংবাদিক আজ বিব্রত। যাঁরা জীবন উৎসর্গ করেন ফ্যাক্ট চেকিং, তথ্য সংগ্রহ, রাতজাগা রিপোর্ট তৈরিতে, তাঁদের জায়গা দখল করে নিচ্ছে কিছু ‘স্মার্ট ফোন হিরো’। তারা বড় বড় অফিসারদের হুমকি দিয়ে, ভিডিও করে, ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে চাঁদা আদায় করে। এক দুঃখজনক ঘটনা মনে পড়ে—এক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফেক সাংবাদিকদের ‘চাঁদাবাজি’র বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে, উল্টো তার বিরুদ্ধেই বানোয়াট নিউজ ছড়িয়ে পড়ল। প্রশ্ন একটাই, এদের রুখবে কে? এটা শুধু কিছু ছদ্ম সাংবাদিকের সমস্যা নয়। এর পেছনে রয়েছে রাজনৈতিক ছত্রছায়া, স্থানীয় ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রশাসনের নিঃক্রিয়তা এবং সর্বোপরি পাঠকের নীরবতা। একজন সাংবাদিকের প্রধান শক্তি হওয়া উচিত নৈতিকতা, তথ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা, এবং জনস্বার্থে কাজ করার সংকল্প। অথচ এখন সাংবাদিকতা যেন এক খোলা বাজার—যেখানে মরিচা ধরা বিবেক আর মিথ্যার চকচকে মোড়কেই মিডিয়া বলা হয়। অপরাধীরাও এখন সাংবাদিকের খোলস পরে। একজন খুনের আসামি কীভাবে চিফ রিপোর্টার হয়ে যায়? একজন চাঁদাবাজ রাতারাতি ফেসবুকে ‘ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার’ হয়ে কীভাবে থানায় ঢুকে যায়? কিছু মিডিয়ার মালিকেরা এসব জানেন, দেখেন, তবু চুপ থাকেন, কারণ তারাও তো ভাগীদার! আর আসল সাংবাদিকেরা? যারা সম্মান নিয়ে বাঁচতে চান, তাঁদের চাকরি নেই, স্যালারি নেই, সামাজিক স্বীকৃতি নেই। বরং এইসব ভুয়া ‘কার্ডবাজদের’ কারণে তারা হন সন্দেহের চোখে দেখা একজন। পুলিশের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, কারণ সাংবাদিক মানেই এখন ‘মিডিয়া’ নয়, অনেকের চোখে চাঁদাবাজ, রাজনৈতিক দালাল কিংবা ভিডিও ভ্লগার। সংবাদপত্রকে সমাজের দর্পণ বলা হয়। এই দর্পণ তৈরি করেন সাংবাদিকরা। রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে সরকার এবং সকল দলের পথ নির্দেশনা তৈরি করে দেয় সংবাদপত্র। এর কারিগর হলো সাংবাদিক সমাজ। সাংবাদিক সমাজ আজ দ্বিধা বিভক্ত। অপসাংবাদিকদের ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকদের মর্যাদার আজ ধুলায় ভুলন্ঠিত। কেন এমন হচ্ছে? একজন সাংবাদিক দেশে ও সমাজের কল্যাণে নিবেদিত হবেন; সাংবাদিকতায় এটি স্বতঃসিদ্ধ । কিন্তু কী হচ্ছে দেশে? মহান পেশার আদর্শ উদ্দেশ্য উল্টে ফেলা হচ্ছে ; সৎ সাংবাদিকদের বিতর্কিত করা হচ্ছে; নানা স্বার্থে সংবাদপত্রকে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। কারা করছে এসব? আজ কেন সাংবাদিকতা বাণিজ্যের ভিড়ে সংবাদপত্র এবং প্রকৃত সাংবাদিকরা অপসৃয়মাণ? কেন মর্যাদাসম্পন্ন পেশা, মর্যাদা হারাচ্ছে। কেন শুদ্ধতার মাঝে ঢুকে পরেছে নাম সর্বস্ব অপসাংবাদিকতা। দুর্নীতি ঢুকে গেছে এ পেশায়। পেশা নয় অসুস্থ ব্যবসা। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতরা অর্থের বিনিময়ে আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি; আর সরলতার সুযোগ নিয়ে হরদম প্রতারণা করছে। যা সাংবাদিকতা আর সংবাদপত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ। যারা হলুদ সাংবাদিকতা করেন কিংবা ৫শ’ টাকায় আন্ডারগ্রাউন্ড পত্রিকার কার্ড এনে দাপট দেখান তারা আমার এ লেখার কোথাও কোথাও বেশ মজা পেয়েছে তাই না? এ বিষয় গুলো আপনাদের জন্য নয়। ভুয়া আর হলুদ সাংবাদিকে ভরে গেছে দেশ। এরা সাংবাদিক নয়, সমাজের কীট। এরা মানুষকে ব্লাকমেইলিং করে টুপাইস কামাচ্ছেন বেশ। এদের কাছ থেকে সবাইকে সাবধান হতে হবে। এতের কারণে, সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা বিষয়ে দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই স্বচ্ছ ধারণা নেই। সাংবাদিক মানেই ধান্ধাবাজ, প্রতারক, ব্লাকমেইলার ও ভীতিকর ব্যক্তি এমন ধারণাই পোষণ করে দেশের গরিষ্ঠ মানুষ। প্রকৃত সাংবাদিকেরা এর কোনটাই নন। সাংবাদিকতা একটা মহান পেশা। এটা কেবল পেশা নয়, একজন সাংবাদিক এ সেবায় থেকে মানুষকে সেবা দিতে পারেন। দেশের কিছু অসৎ সম্পাদক, সাংবাদিক অর্থের বিনিময়ে সারা দেশে নানা অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের সাংবাদিকতার পরিচয়পত্র দিয়ে এ পেশার সম্মানহানি করছে। এরা সাংবাদিক নন। সাংবাদিক নামধারী।সমস্যাটা এখানেই। দেশে হরেদরে সাংবাদিক পরিচয় ব্যবহারের সুযোগ আছে। এই সুযোগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিয়ন্ত্রণ আরোপে প্রকৃত সাংবাদিকদের সাহসী উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশে সাংবাদিক হতে কোনো সুনির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। হুট করেই সাংবাদিক হয়ে যেতে পারে যে কেউ। না, এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতাও কোনো বিষয় নয় ! সুশিক্ষিত ও মানসম্পন্ন সাংবাদিক ও কলামিস্ট এদেশে অনেকেই আছেন, যারা তাদের ক্ষুরধার ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনী দ্বারা সমাজের অনেক অসঙ্গতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে আমাদের সমাজ সচেতন করে তোলেন প্রায়ই। সেই গুটিকয়েক নমস্য সাংবাদিকের সাথে মিশে গেছে সাংবাদিক নামধারী (লেবাসধারী) কিছু নর্দমার কীট; আসলে এরাই বর্তমানে সংখ্যায় বেশি। এসব অপসাংবাদিকতা ইদানীং সাংঘাতিক রকম বেড়ে গেছে। অপ-সাংবাদিক সৃষ্টি এক ধরনের সাংবাদিকতা নির্যাতন। আমরা চাই, সাংবাদিকতা পেশা যেন আগের সৎ ও নির্ভীক চেহারায় ফিরে আসে।এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যারা এসব অপসাংবাদিক তৈরি করছে তারা সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মতো মহান পেশাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যেই তা করছে। এটা কোনো সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রও হতে পারে। এসব ষড়যন্ত্রকারীদের চিহ্নিত করতে হবে। তাদের প্রতিহত করতে হবে। নইলে বড্ড বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে এ মহান পেশায়। সাংবাদিক নামধারী অপসাংবাদিকদের বিষয়ে কিছু না বলে পারছি না। সাংবাদিকতা একটি স্পর্শকাতর পেশা। যে কারো হাতে যেভাবে ছুরি কাঁচি তুলে দিয়ে অপারেশনের সার্জন বানিয়ে দেয়া গ্রহণযোগ্য হয় না, একইভাবে যে কারো হাতে পরিচয়পত্র, কলম-ক্যামেরা-বুম তুলে দিয়ে তাকে সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচারের দায়িত্ব দেয়াটাও গ্রহণযোগ্য হওয়া উচিত নয়। আজকাল মাঠ পর্যায়ে গিয়ে এ পেশা সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য অনেকের কাছে শুনতে হয়। আজকের এ নিবন্ধ ধাঁন্দাবাজ, হলুদ সাংবাদিক এবং অপসাংবাদিককে ঘিরে, যারা সাম্প্রতিক কালে এ মহান পেশাকে কলুষিত করে রেখেছেন, অপেশাদার মনোভাব তৈরি করে সাংবাদিকতা-বাণিজ্য চালু করেছেন। এদের রাহুগ্রাস থেকে সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের বেরিয়ে আসতে হবে। এমনিতেই নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। এভাবে চলতে পারে না। চলতে দেয়া যায় না। এই বাস্তবতায় প্রশ্ন একটাই: কে ফিরিয়ে আনবে সত্যিকারের সাংবাদিকতা? তথ্য মন্ত্রণালয়? প্রেস কাউন্সিল? নাকি সেই পাঠক, যিনি মুখে কিছু বলেন না, কিন্তু হৃদয়ে এখনো সত্য আর মর্যাদার জন্য অপেক্ষা করেন? সময় এসেছে সাংবাদিকতার সংজ্ঞা পুনর্গঠনের। সময় এসেছে বলার: সাংবাদিকতা কার্ডে নয়, চরিত্রে। মিডিয়া অফিসে নয়, মানুষের আস্থায়। আসুন, আমরা সেই সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াই, যাঁরা আজও নীরবে সত্যের পক্ষে কলম চালান। যাঁদের হাতে আজও অন্ধকারে আলো জ্বালানোর সাহস আছে। না হলে খুব শীঘ্রই হয়তো হেডলাইন হবে: “প্রেস কার্ডসহ ডাকাত গ্রেপ্তার!” ✍ লেখক: মীর আব্দুল আলীম, সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ। |