![]() ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফর ও কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। অন্যদিকে সৌদি আরব নিজস্ব বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি চালু করতে চায়। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অনুমোদন ও সহায়তা চেয়েছে দেশটি। ট্রাম্পের সফরের আরেকটি প্রধান আলোচ্য বিষয় হলো গাজা উপত্যকার ভবিষ্যৎ। তিনি এই যুদ্ধের অবসান ঘটাতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে গাজা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যও করেছেন তিনি। সম্প্রতি বলেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। শুধু তা-ই নয়, তিনি গাজাকে গুরুত্বপূর্ণ আবাসন প্রকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। সিরিয়ার নতুন সরকারের ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিষয় নিয়েও এই সফরে আলোচনা হতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ব্রাঞ্চ। এ ছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন পারস্য উপসাগরের নাম পাল্টে আরব উপসাগর হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে বলেও শোনা যাচ্ছে। আরব দেশগুলো নতুন নাম উত্সাহের সঙ্গে গ্রহণ করলেও ইরান কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। তেলের দাম নিয়ে আলোচনাও গুরুত্ব পাবে। ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোকে (ওপেক) তেলের উৎপাদন বাড়াতে চাপ দিয়ে আসছিলেন, যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ভোক্তাদের জন্য দাম কমানো যায়। তাই এই সফরে তেলের উৎপাদন বাড়ানো নিয়ে সৌদি আরবের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হতে পারে। বিশ্লেষকের মতে, চুক্তিগুলোর মাধ্যমে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি একে অপরের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হবে। উভয় দেশে যৌথ উদ্যোগ গড়ে উঠবে। পাশাপাশি আরও বেশি মার্কিন অস্ত্র ও পণ্য কেনা হবে। সৌদি আরবের বিনিয়োগ তহবিল পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের (পিআইএফ) অধীন বর্তমানে ৯২৫ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের সম্পদ রয়েছে। পিআইএফ এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে একাধিক বড় বিনিয়োগ করেছে। এসবের মধ্যে অ্যাপভিত্তিক পরিবহনসেবা উবার, ভিডিও গেম নির্মাতা ইলেকট্রনিক আর্টস ও বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা লুসিডে বিনিয়োগ অন্যতম। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) যুক্তরাষ্ট্রে আগামী ১০ বছরে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), সেমিকন্ডাক্টর, জ্বালানি ও উৎপাদন খাতসহ নানা ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করবে। গত মার্চে ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে আমিরাতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শেখ তাহনুন বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের বৈঠকের পর হোয়াইট হাউস এসব তথ্য জানিয়েছিল। তবে স্বল্প মেয়াদে এসব বিনিয়োগ বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করেন মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের অর্থনীতিবিদ ক্যারেন ইয়ং। এগুলো দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত পদক্ষেপ মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিনিয়োগের যে সংখ্যা উল্লেখ করা হচ্ছে, তা কিছুটা সংশয় নিয়ে দেখা উচিত। ট্রাম্পের চলতি মধ্যপ্রাচ্য সফরে একাধিক চুক্তির ঘোষণা আসতে পারে। এর মধ্যে সৌদি আরবের ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্যের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কেনার সিদ্ধান্ত অন্যতম। এ চুক্তির আওতায় ক্ষেপণাস্ত্র, রাডার সিস্টেম ও পরিবহন বিমানের মতো গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম অন্তর্ভুক্ত থাকবে।এ সফরে ট্রাম্পের আলোচ্যসূচির আরেকটি বড় বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। আলোচনায় প্রধানত দুটি বিষয় উঠে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে-যেমন, মার্কিন প্রযুক্তি খাতে উপসাগরীয় দেশগুলোর বিনিয়োগ আরও বাড়ানো এবং অঞ্চলটিকে সর্বাধুনিক মার্কিন সেমিকন্ডাক্টরে প্রবেশাধিকার দেওয়া। আমিরাত ও সৌদি আরবের অর্থনীতি এখন পর্যন্ত প্রধানত জ্বালানি তেলনির্ভর। তারা নিজেদের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে চাইছে। এ জন্য প্রযুক্তি ও এআই খাতে শত শত কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে। বিশেষ করে আমিরাত নিজেদের একটি আন্তর্জাতিক এআই কেন্দ্রে পরিণত করতে চায়। চলতি বছরের শুরু থেকে বিশ্বব্যাপী তেলের দাম পতনের কারণে রিয়াদের অর্থনীতির ওপর চাপ আরও বেড়েছে। ফলে উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো টিকিয়ে রাখতে দেশটির ওপর ঋণ বাড়াতে বা ব্যয় কাটছাঁট করতে ক্রমশ চাপ বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হওয়ায় জ্বালানি তেলের দাম চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেক প্লাসের উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা ঘোষণায় পণ্যটির দাম আরও কমেছে। সৌদি আরব ওপেক প্লাসের সদস্য। কিছু বিশ্লেষকের মতে, ট্রাম্পকে খুশি করতেই জ্বালানি তেলের উত্তোলন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ওপেক প্লাস। কারণ, তিনি তেলের দাম কমানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। অন্য কিছু বিশ্লেষকের মতে, ওপেক প্লাস বিশ্বব্যাপী অর্থনীতি চাঙা হওয়ার বিষয়ে আত্মবিশ্বাসী। মূলত এ কারণেই তারা পণ্যটির উত্তোলন বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। ইউএস-সৌদি বিজনেস কাউন্সিলের আশা, ট্রাম্পের সফরের ফলে মার্কিন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো সৌদি আরবে বিনিয়োগ বাড়াতে আরও বেশি উৎসাহী হবে। বিশেষ করে দেশটির এআই, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা খাতে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়তে পারে।সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। গ্রিসের অ্যাথেন্সে ম্যাক্সিমোস ম্যানশনে, ২৬ জুলাই ২০২২ ইউএস-সৌদি বিজনেস কাউন্সিলের রিয়াদ কার্যালয়ের প্রধান হুথাম আল জালাল বলেন, সৌদি সরকার এ খাতগুলোতে বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে।সৌদি কোম্পানিগুলোর মধ্যে মার্কিন কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ব্যাপারে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। সৌদি কর্মকর্তারা বলেছেন, ট্রাম্পের সফরের সময় এ খাতগুলোতে কিছু চুক্তি হওয়ার বিষয়ে তাঁরা আত্মবিশ্বাসী। সৌদি আরবের জন্য ট্রাম্পের সফরের অর্থ হলো, নিজেদের সবচেয়ে পুরোনো পশ্চিমা মিত্রদেশটির সঙ্গে সম্পর্ক শক্তিশালী করা, যা বাইডেন প্রশাসনের সময়ে কিছুটা চাপের মধ্যে পড়েছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য সৌদি সফরের অর্থ হলো, এমন সব বিনিয়োগ চুক্তি সম্পন্ন করা, যাকে তিনি নিজের অর্থনৈতিক কর্মসূচির বিজয় বলে তুলে ধরতে পারবেন। বিশ্লেষকরা বলছেন,প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চাচ্ছেন এমন একটি শিরোনাম, যা যুক্তরাষ্ট্রে বড় বিনিয়োগের বার্তা দেবে। আর এই সফর থেকে তিনি সেটা পেয়ে যাবেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস) এক কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। এই চুক্তির ফলে আমেরিকা তার পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য এবং জাতীয় নিরাপত্তা লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে। এই চুক্তির ফলে সৌদি আরবের নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে যা মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সৌদি আরবের কাছে সরঞ্জাম এবং সমর্থন বিক্রি এই অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্যের উপর কোন প্রভাব ফেলবে না বা আমেরিকার প্রস্তুতির ক্ষতি করবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে এই চুক্তি এটি ইঙ্গিত দিতে পারে যে আমেরিকা এবং সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। বর্তমান এই চুক্তির তাৎপর্য হচ্ছে; ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর আরব রাষ্ট্রগুলি ইরানের শক্তি সম্পর্কে সতর্ক হয়ে গেছে। তাই তারা তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে। তবে চুক্তির ধরন দেখে মনে হচ্ছে আমেরিকা আগের নীতিতেই আছে। অর্থাৎ আরবের নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র দুইটাই দিবে কিন্তু আমেরিকা সরাসরি জড়িত হবে না। ট্রাম্পের এ সফরের প্রায় সব মনোযোগ উপসাগরীয় দেশগুলো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে বিনিয়োগ আনার দিকে নিবদ্ধ থাকছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ট্রাম্পের এ সফর সৌদি আরবের ‘ভিশন ২০৩০-এর জন্য মার্কিন বিনিয়োগ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রেও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি সরকার নিজেদের অর্থনীতি ঢেলে সাজানোর যে উদ্যোগ নিয়েছে, তার কেন্দ্রে আছে ভিশন ২০৩০। এর আওতায় বিশাল বিশাল নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে ‘দ্য লাইন’ নামের একটি লিনিয়ার শহর তৈরি অন্যতম। ভিশন ২০৩০-এর অধীন বিনোদন, পর্যটন, খনি ও ক্রীড়া খাতেও বিপুল বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে সৌদি আরবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তৃতীয় বছর বিদেশি সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে। দেশটি যে বিদেশি মূলধন আকর্ষণের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জে রয়েছে, এর মধ্য দিয়ে সেটা বোঝা যায়। হোয়াইট হাউস জানিয়েছে, প্রতিরক্ষা চুক্তির পাশাপাশি আরও কয়েকটি রূপান্তর মূলক বিনিয়োগ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যার মোট মূল্য ৬০০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি, শক্তি ও খনিজ শিল্প খাতে বেশ কয়েকটি বড় ধরনের চুক্তি। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে গুগল, এনভিডিয়া, অ্যামাজন, ওপেনএআই, টেসলা ও বোয়িংয়ের শীর্ষ নির্বাহীদের উপস্থিতি বিশ্বজুড়ে আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুবরাজ সালমানের নেতৃত্বের প্রশংসা করে বলেন, ‘আমাদের দুই দেশের ব্যবসায়িক সম্পর্ক অভূতপূর্ব উচ্চতায় পৌঁছেছে।’ বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাচ্ছে, যা মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যকেও প্রভাবিত করতে পারে। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |