![]() ইশরাকের আন্দোলন নিয়ে বিএনপিতে দুই মত: ৩৩ দিন ধরে অচল নগর ভবন
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে: জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ ইস্যুতে লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনার পর ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো ইস্যুতে চলমান আন্দোলন থেকে ইশরাক হোসেনের সরে যাওয়া উচিত বলে মনে করে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটি লন্ডন বৈঠকের পর এই আন্দোলনকে আর সমর্থন করে না। বিএনপি মনে করে, এখন আর আন্দোলন চললে সরকারের কাছে ভুল বার্তা যাবে। গত সোমবার রাতে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অধিকাংশ নেতা এমন অভিমত দেন বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘নির্বাচন ইস্যুতে লন্ডনে ফলপ্রসূ বৈঠকের পর আমরা এখন আর এই আন্দোলনের পক্ষে না। এতে ইশরাকের যেমন ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তেমনি বিএনপিরও ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। বিএনপির লক্ষ্য এখন জাতীয় নির্বাচন।’ ‘লন্ডন বৈঠকের’ পর রাজধানীর গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত স্থায়ী কমিটির এই বৈঠকে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সূত্র মতে, বৈঠকে ‘লন্ডন বৈঠক’ ছাড়াও ইশরাকের শপথ ইস্যু এবং আগামী নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ইশরাকের শপথ ইস্যুতে নগর ভবন ঘিরে চলমান আন্দোলন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনা হয়েছে। দু-একজন ছাড়া অধিকাংশ নেতা অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, নির্বাচন ইস্যুতে লন্ডনে গত শুক্রবার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মধ্যে একটি ফলপ্রসূ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকট ও অনিশ্চয়তা কেটে যাওয়ার পাশাপাশি এক ধরনের স্বস্তিও ফিরে এসেছে। একই সঙ্গে নির্বাচন ইস্যুতে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কিছুদিন ধরে চলা বিএনপির টানাপোড়েনমূলক সম্পর্কেরও অবসান ঘটেছে। এমন অবস্থায় ইশরাকের শপথ ইস্যুতে আন্দোলন চললে সরকারের কাছে ভুল মেসেজ যাবে। তা ছাড়া সিটি করপোরেশনের মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। তাই সবদিক বিবেচনায় আন্দোলন থেকে এখন ইশরাকের সরে যাওয়া উচিত। সভায় বাকি দু-একজন নেতা অভিমত প্রকাশ করে বলেন, লন্ডন বৈঠকের পর ইশরাক আন্দোলন থেকে পিছু হটলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে যে, সরকারের সঙ্গে বিএনপির সব বিষয়ে সমঝোতা হয়ে গেছে। এতে সমালোচকরাও সুযোগ পেয়ে যাবে। তাই রয়ে সয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া উচিত। তবে বৈঠকে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এদিকে, গতকাল রাতে ইশরাককে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের অফিসে ডেকে পাঠানো হয়। জানা গেছে, সেখানে বিএনপির হাইকমান্ডের সঙ্গে তার বৈঠক হয়েছে। উপদেষ্টার পদত্যাগ চান ইশরাক: স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার পদত্যাগ দাবি করেছেন ইশরাক হোসেন। পাশাপাশি উপদেষ্টার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করতে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। গতকাল নগর ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে ইশরাক বলেন, ‘জনগণের শ্রদ্ধাশীল আচরণ, আদালতের রায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন তার কাছ থেকে কাম্য। অসত্য তথ্য দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করা তার কাজ নয়। কারণ, এত অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে সেসব জনগণ তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি, তাদের তিনি বিভ্রান্ত করতে পারবেন না। অসত্য এবং বিভ্রান্তিমূলক তথ্য গণমাধ্যমে উপস্থাপন করায় স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার পদে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন। তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। শপথ ভঙ্গ করার জন্য আমরা তার পদত্যাগ দাবি করছি।’ সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ইস্যুতে স্থানীয় সরকার বিভাগ কোনো আইন ভঙ্গ করেনি। বিষয়টি বিচারাধীন থাকা অবস্থায় গেজেটের মেয়াদ এবং পরবর্তী সময়ে সিটি করপোরেশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের শপথ দেওয়ার কোনো আইনি সুযোগ নেই। সজীব ভূঁইয়ার বক্তব্যের সমালোচনা করে ইশরাক অভিযোগ করে বলেন, নানা ধরনের প্রশ্ন তুলে মেয়র পদে তার শপথ অনুষ্ঠান বিরত রাখা হয়েছে। উপদেষ্টার কথা সত্যি হলে ভবিষ্যতে অনেক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি শপথ নিতে পারবেন না। অর্থাৎ বিজয়ী প্রার্থীর নামে গেজেট প্রকাশ হলে পরাজিত প্রার্থী অথবা যে কোনো একজন নাগরিককে সজীব ভূঁইয়ার মতো ব্যক্তি ইন্ধন দিয়ে শপথ না পড়ানোর জন্য হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করাবেন। আর ওই রিট মামলাটি অনিষ্পন্ন থাকলে গেজেটে উল্লিখিত ৩০ দিন মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কোনো জনপ্রতিনিধি শপথ পড়ার সুযোগ পাবেন না। কারও নাম না নিয়ে ইশরাক হোসেন বলেছেন, ‘স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা তার পছন্দের একজনকে প্রশাসক নিয়োগ করে রাজনৈতিক ও অন্যায়ভাবে আর্থিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছেন। আমি দুর্নীতি দমন কমিশনকে আহ্বান জানাতে চাই, আপনারা এখানে আসুন। যতদিন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া অফিস করেছেন, কী কী দুর্নীতি করে গেছেন, তা আপনারা তদন্ত করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। রক্তাক্ত গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার বিনিময়ে উপদেষ্টার পদ পেয়েছেন। এত কম সময়ে কীভাবে তারা এই পরিমাণ দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেলেন?’ গত মাসের আন্দোলন নিয়ে ইশরাক বলেছেন, তাদের আন্দোলন সচিবালয় ছাড়িয়ে যমুনা পর্যন্ত গিয়েছিল। পরে সরকারের কাছ থেকে বিষয়টি সুরাহা হবে—এমন একটি বার্তা তিনি পেয়েছিলেন। এ ছাড়া জনগণের ভোগান্তির কথা চিন্তা করেও সেখান থেকে সরে এসেছিলেন জানিয়ে ইশরাক সতর্ক করেছেন, সংকটের সুরাহা না হলে ফের আন্দোলন রাজপথে গড়াবে। সরকারকে দায়ী করে ইশরাক বলেন, আজকের অবস্থার জন্য দায়ী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার এবং এর উপদেষ্টারা। প্রধান উপদেষ্টা এটিকে এড়িয়ে যেতে পারেন না। আমি উনার উদ্দেশে বলতে চাই, বিষয়টি আপনার নজরে আনুন। যৌক্তিক সমাধান করে ঢাকাবাসীকে মুক্তি দিন। এদিকে, শপথের মাধ্যমে দায়িত্ব বুঝে না পেলেও গতকালও নগর ভবনের একটি মিলনায়তনে সংস্থাটির প্রায় ৭০টি ওয়ার্ডের সচিবদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ইশরাক হোসেন। সোমবার ৭০ জনের বেশি পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শককে নিয়ে বৈঠক করেছিলেন তিনি। গতকালও বেলা ১১টা থেকে নগর ভবন প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন ইশরাকের সমর্থক ও ঢাকা দক্ষিণ সিটির কর্মচারীরা। ইশরাককে মেয়রের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার দাবিতে ১৪ মে থেকে ঢাকাবাসীর ব্যানারে নগর ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছেন তার সমর্থকরা। পরদিন ১৫ মে থেকে তারা নগর ভবনের সব ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন। শপথ না নিয়েই ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিভিন্ন সভায় অংশ নিয়ে ইশরাক হোসেন সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার মতো ক্রিমিনাল অফেন্স করেছেন বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। নাগরিক সেবাদানে বাধা দেওয়ার অভিযোগ এনে তিনি বলেন, ইশরাক হোসেন নগর ভবনের মিলনায়তন ও অফিস দখল করে নাগরিক সেবাদানে বাধা দিচ্ছেন। ইশরাক হোসেনের প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। আসিফ মাহমুদ বলেন, ইশরাক হোসেন অফিসিয়ালি কোনো দায়িত্ব নেননি। কিন্তু নেতাকর্মীদের নিয়ে গিয়ে নগর ভবনের মিলনায়তন, অফিস দখল করেছেন। নির্দিষ্ট সময়ে ইশরাককে শপথ না পড়ানো ভুল সিদ্ধান্ত: শপথ নিয়ে চলমান সংকটের সমাধান আদালত থেকে আসতে পারে বলে মনে করেন স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান। জানতে চাইলে কালবেলাকে তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এখন শপথ নেওয়ার সুযোগ নেই বলে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, এই ব্যাখার আইনগত দিক নিয়ে আলোচনা হবে। যখন এই মামলাটি আদালতে চলছিল তখন সরকারের পক্ষ থেকে কেন আদালতে যাওয়া হয়নি? তখন আদালতে গিয়ে সরকারের পক্ষে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত ছিল। এখন সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, সেটি সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া উচিত। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এখন কাউকে শপথ পড়ানোর কোনো অবকাশ নেই। করপোরেশনের মেয়াদ থাকতে শপথ পড়ানো হয়নি। এটা ভুল করেছে। সে সময় শপথ পড়ালেও মেয়াদ ছিল এক বা দেড় মাস। এখন শপথ পড়ানো হবে কীভাবে?’ নাগরিক সেবা বন্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জনগণের নেতারা যদি জনগণকে সেবা না দেন, বাধা দেন তাহলে কী করবেন? তার (ইশরাক হোসেন) যদি ওইরকম রাজনৈতিক দূরদর্শিতা থাকতে, তাহলে সিটি করপোরেশনের নির্বাচন চাইতে। নির্বাচন না চেয়ে উনি নগর ভবন দখল করে বসে থাকেন কীভাবে? আমি তো এখানে কোনো ন্যায্যতা দেখি না।’ লাখো নগরবাসী ভোগান্তিতে: মেয়ের জন্মনিবন্ধন সংশোধনের জন্য ২০ দিন ধরে নগর ভবনে ঘুরছেন জুরাইনের বাসিন্দা রফিক মিয়া। কাজটি না হওয়ায় মেয়ের পাসপোর্ট করাতে পারছেন না তিনি। ক্ষোভ নিয়ে তিনি বলেন, ‘শুনেছিলাম আজ থেকে সিটি করপোরেশনের দৈনন্দিন কার্যক্রম চলবে। এসে দেখি মূল ফটকে তালা। সব প্রশাসনিক কাজ বন্ধ। এই ভোগান্তি আর ভালো লাগে না। ঈদের আগে থেকে মেয়ের জন্মনিবন্ধন সংশোধনের জন্য ঘুরছি। ২০ দিনের বেশি সময় হয়ে গেলেও তা ঠিক করতে পারছি না। ফলে তার পাসপোর্টের জন্য আবেদনও করতে পারছি না।’ একই অবস্থা রাজীব হোসেনেরও। ট্রেড লাইসেন্স করাতে এসেছিলেন তিনি। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতিদিনই এসে ফিরে যাচ্ছি। আন্দোলন চলুক, কিন্তু সেবা তো বন্ধ করা ঠিক নয়। সাধারণ মানুষ কী দোষ করল?’ নগর ভবনের অভ্যর্থনা ডেস্কের দায়িত্বে থাকা মো. দুলাল জানান, ‘নগর ভবনের সব কার্যক্রম বন্ধ। প্রধান ফটকসহ সব দরজা বন্ধ। এমন কী লিফটও বন্ধ। তাই চাইলেও কেউ অফিসে আসতে পারছেন না।’ ডিএসসিসির প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের দাপ্তরিক কাজগুলোর কোনোটাই করা যাচ্ছে না। ময়লা পরিষ্কার, মশার ওষুধ বিতরণ, সড়কবাতি লাগানোর মতো কাজও স্বাভাবিকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। অসংখ্য প্রয়োজনে প্রতিদিন হাজারো মানুষ নগর ভবনে আসেন। কিন্তু তাদের কষ্টের কথার কোনো জবাব দিতে পারছি না। দু-চারটি জরুরি সেবা ছাড়া কোনো সেবাই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’ |