![]() ইরানের কাছে কীভাবে এলো বহুল আলোচিত পরমাণু প্রযুক্তি
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক বোমা তৈরির গোপন কর্মসূচি বন্ধে আগাম ব্যবস্থা হিসেবে এ হামলা চালানো হয়েছে। কিছু দিন আগে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থাও (আইএইএ) জানিয়েছিল, ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরির খুব কাছাকাছি রয়েছে এবং তাদের কাছে পরমাণু তৈরির অন্যতম উপাদান ইউরেনিয়াম যে পরিমাণ রয়েছে তা দিয়ে অন্তত ৯টি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি সম্ভব। হামলার প্রেক্ষাপট জাতিসংঘের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) অনুযায়ী, ইরান শুধুমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি তৈরিতে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ তৈরি করতে পারবে, কিন্তু পরমাণু অস্ত্র তৈরির জন্য কোনো কার্যক্রম চালাতে পারবে না। এছাড়া ৩.৬৭ শতাংশের বেশি ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করাও যাবে না। কিন্তু আইএইএ বলছে, সাম্প্রতি সময়ে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ এবং ৪০০ কেজিরও বেশি ইউরেনিয়াম মজুদ করেছে ইরান। পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে ইউরিয়াম ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ করতে হয়, যার কারণে ইরান পারমাণবিক শক্তিধর হওয়ার জন্যই অগ্রসর হচ্ছিল বলে ধারণা করা হয়। এরপরই সতর্ক বার্তা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দুইমাসের মধ্যে চুক্তি করার জন্য ইরানকে আল্টিমেটাম দেন, যাতে তারা পরমাণু গবেষণা কার্যক্রম বন্ধ করে। এছাড়া ইসরায়েল দিতে থাকে সামরিক অভিযানের হুমকি। এরই ধারাবাহিকতায় ঠিক দুইমাস পেরোতেই ইরানজুড়ে হামলা শুরু করে ইসরায়েল। কীভাবে ইরানের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি ইরানের পারমাণবিক গবেষণাকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- নাতাঞ্জ, ফোর্দো, খোনদাব, ইসফাহান, বুশেহর ও তেহরান রিসার্চ রিঅ্যাক্টর। এর মধ্যে দেশটির সবচেয়ে বড় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র হলো নাতাঞ্জ, যেখানে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পাত্র বা সেন্ট্রিফিউজ থাকার সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ৫০ হাজার। এই পরমাণু কেন্দ্রটি মাটির প্রায় ১০০ মিটার গভীরে অবস্থিত। ফোর্দো পরমাণু স্থাপনাটিও পাহাড়ের নিচে অবস্থিত। এরকমভাবে প্রায় প্রতিটি পরমাণু প্রকল্প সর্বোচ্চ নিরাপদ রাখতে বিশেষভাবে নির্মাণ করেছে ইরান। অনেক দেশ যখন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিভিন্ন পরাশক্তির সহায়তায় নির্মাণ ও সার্বিক বাস্তবায়ন করে থাকে সেখানে এককভাবে বিশ্বের সব থেকে আলোচিত ও বিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি কীভাবে হাতে পেল ইরান তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সূত্রে জানা যায় ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের হাত ধরেই। ১৯৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু করে তৎকালীন পশ্চিমাপন্থি ইরানের সরকার। ১৯৭৯ সালে মার্কিন নীতি বিরোধী বিপ্লবী সরকার ইরানের ক্ষমতায় বসে। মার্কিন ও পশ্চিমা বিরোধী হওয়ায় পরমাণু কর্মসূচি তেহরান সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে বলে উদ্বেগ তৈরি হয় দেশগুলোর মধ্যে। তবে তখনও পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতা অর্জনের মতো প্রযুক্তি ইরানের কাছে ছিল না বলেই মনে করা হয়। কিন্তু ২০০২ সালে আন্তর্জাতিক পরিদর্শকরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শনকালে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম আবিষ্কার করেন, যার ফলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয় ইরানের বিরুদ্ধে। এরপরই প্রশ্ন ওঠে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের অন্যতম পাত্র সেন্ট্রিফিউজ কীভাবে হাতে পেল ইরান। ধারণা করা হয়, পাকিস্তানের কাছ থেকে তেহরান এই প্রযুক্তি হাতে পায়। পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের জনক আবদুল কাদির খান নেদারল্যান্ডে পরমাণু গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইউরেনকোতে কাজ করার সময় সেন্ট্রিফিউজের নকশা চুরি করে পাকিস্তানে পাড়ি দিয়েছিলেন। ইরানের সেন্ট্রিফিউজগুলো সেই ধরনের মনে হওয়ায় এমনটি ধারণা করা হয় যে পাকিস্তান থেকেই প্রযুক্তি পেয়েছে দেশটি। কাদির খান শুধু পাকিস্তানেই পারমাণবিক অস্ত্র বানিয়ে থেমে থাকেননি। তার এই অস্ত্রের নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন ২০টির বেশি দেশে। এর মধ্যে ছিল আরবের অনেক দেশ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৭ সালে ইরানের কাছে সেন্ট্রিফিউজের যন্ত্রাংশ ও নকশা সরবরাহের মধ্য দিয়ে তার প্রথম বড় ধরনের বিস্তার কার্যক্রম শুরু হয় বলে মনে করা হয়। এরপর লিবিয়া এবং ইরাকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করেন তিনি। খান বৈশ্বিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী, ভুয়া কোম্পানি এবং দুবাই, মালয়েশিয়া, তুরস্ক ও ইউরোপে অবস্থিত ট্রান্সশিপমেন্ট হাবের মাধ্যমে উপকরণের উৎস এবং গন্তব্য গোপন রাখতেন। ২০০৩ সালে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে পাঠানো সেন্ট্রিফিউজ যন্ত্রাংশের চালান ধরা পড়ার পর খানের নেটওয়ার্ক ফাঁস হয়। সেসময় ‘মানববিধ্বংসী অস্ত্র’ রাখার অভিযোগে ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর একেবারে ভেঙে যায় লিবিয়া ও ইরাকের পরমাণু অস্ত্রের স্বপ্ন। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট গাদ্দাফি বুঝতে পারেন যে এরপর তার দেশে হামলা হতে পারে। তিনি সিআইএসহ পশ্চিমা বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে দেনদরবার শুরু করেন। আন্তর্জাতিক চাপের কারণে পাকিস্তানের জাতীয় টেলিভিশন চ্যানেলে ড. খান তার ‘গোপন পরমাণু ব্যবসা’র কথা স্বীকারও করেন। লিবিয়া-যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্য আলোচনা থেকেই জানা যায় ড. কাদির খান ইরানের কাছে পরমাণু সংক্রান্ত নথি বিক্রি করেছেন। এরপর ২০০৬ সালে রাশিয়া ও চীনের সম্মতিতে নিরাপত্তা পরিষদ ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সেই নিষেধাজ্ঞার পর ইরান তার পরমাণু কর্মসূচি গোপনে চালিয়ে যেতে থাকে। ইউরোপ-আমেরিকায় পড়ালেখা করা নিজেদের পরমাণু বিজ্ঞানী থাকায় নিজেদের মতো করে পরমাণু কর্মসূচি চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় তেলসমৃদ্ধ ইরানের। লিবিয়া, ইরাকের মতো আরব দেশগুলোর পরমাণু গবেষণা কার্যক্রম ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারা ধ্বংস হলেও বিপ্লবী চেতনা, নিজেদের জ্ঞান ও বিচক্ষণতায় ইরানের মাটিতে আজও টিকে রয়েছে পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনাগুলো। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের পাশাপাশি বোমা তৈরির নকশা এবং ডেলিভারি সিস্টেম বা বহনের প্রযুক্তি তৈরি করাও দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। তাই পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতা অর্জনে ইরান কতটা এগিয়ে রয়েছে তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা এখনো অজানা। |