![]() গাজায় বর্বরতার জেরে কূটনৈতিক সংকটে ইসরায়েল
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার আজ এমন এক কূটনৈতিক সংকটে পড়েছে, যেখানে তার দীর্ঘদিনের পশ্চিমা সহযোগীরাও আর প্রকাশ্যে সমর্থনে এগিয়ে আসছেন না। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক হামলার পর নেতানিয়াহুর প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ছিল নজিরবিহীন। বিশ্বজুড়ে নেতারা ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারে সরব সমর্থন জানান। কিন্তু যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজার মানবিক বিপর্যয় আরও প্রকট হয়। প্রাণহানি, খাদ্য সংকট, ওষুধের ঘাটতি এবং জরুরি সহায়তা বন্ধের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। চলতি বছরের মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতির চুক্তি বাতিল করে ইসরায়েল গাজায় নতুন করে হামলা শুরু করে এবং একই সঙ্গে খাদ্য, পানি ও ওষুধের প্রবেশ বন্ধ করে দেয়। এই পদক্ষেপের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্যান্য পশ্চিমা মিত্রদের সমর্থন একে একে হারিয়েছে নেতানিয়াহু। এ মাসের শুরুতে জিম্মিদের মুক্ত করতে ও যুদ্ধ বন্ধের একটি শান্তিচুক্তির সুযোগ এলেও ইসরায়েল তা প্রত্যাখ্যান করে গাজার কেন্দ্রীয় শহর রাফায় ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে। এর ফলে আন্তর্জাতিক চাপ আরও তীব্র হয়। ১৯ মে ফ্রান্স, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের নেতারা এক যৌথ বিবৃতিতে স্পষ্টভাবে ইসরায়েলের বর্তমান কর্মকাণ্ডকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন। ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার বলেন, নেতানিয়াহু সরকার যদি এই জঘন্য আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং মানবিক সহায়তায় বাধা সৃষ্টি করে, তবে আমাদের প্রতিক্রিয়া আরও কঠোর হবে। এই বিবৃতির জবাবে নেতানিয়াহু ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে দাবি করেন, এই তিন নেতা হামাসের পক্ষেই কাজ করছেন। এক ভিডিওবার্তায় তিনি বলেন, যারা গণহত্যাকারীদের প্রতি নমনীয়তা দেখায়, তারা ইতিহাস, মানবতা ও ন্যায়বিচারের ভুল দিকে দাঁড়িয়ে আছেন। ইসরায়েলের প্রতি কূটনৈতিক সমর্থন কমার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। যুক্তরাজ্য ইসরায়েলের সঙ্গে চলমান বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছে এবং বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। ফ্রান্স আগামী মাসে সৌদি আরবে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে যাচ্ছে, যেখানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ব্যাপারে আলোচনা হবে। স্পেন ইতিমধ্যে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ ইসরায়েলকে ‘গণহত্যাকারী রাষ্ট্র’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতা থেকেও ইসরায়েলকে নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এদিকে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তত ১৭ জন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য ও সহযোগিতা চুক্তি পুনর্বিবেচনার পক্ষে মত দিয়েছেন। মাল্টাও শিগগিরই ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। ইসরায়েল সরকারের ভেতর থেকেও সতর্কবার্তা এসেছে। মার্চে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিদিওন সা’আর নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছিলেন—মানবিক সহায়তা বন্ধ করলে হামাস দুর্বল হবে না, বরং তা ইসরায়েলের আন্তর্জাতিক বন্ধন ছিন্ন করবে। বাস্তবতা এখন সেটিই প্রমাণ করছে। এক জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি কর্মকর্তা বলেন,“আমরা ভয়াবহ কৌশলগত ভুল করেছি। এই সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়নের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তবুও নেতানিয়াহু সম্প্রতি প্রথমবারের মতো বলেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ শেষ হবে না। এই পরিকল্পনার অধীনে গাজার মানুষকে প্রথমে একটি তথাকথিত ‘মানবিক জোনে’ এবং পরে বিদেশে স্থানান্তর করার প্রস্তাব রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল যদি এই ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে, তবে আন্তর্জাতিক মিত্রতা আরও দ্রুত হারাবে এবং নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতার দেয়াল আরও ঘনীভূত হবে। ইসরায়েল আজ এমন এক কূটনৈতিক সংকটে পড়েছে, যা যুদ্ধক্ষেত্রে তার অর্জনের চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মিত্র হারানো, সমালোচনার ঝড় এবং যুদ্ধের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলায় ইসরায়েল এখন কেবল যুদ্ধের নয়, কূটনীতির ময়দানেও এক অস্থিরতার মুখোমুখি। |