![]() অপুষ্টিতে রয়েছে ৫ বছরের কম বয়সি প্রায় ৭১,০০০ শিশু
প্রতি ৫ জনে ১ জন অনাহারে: সেপ্টেম্বরেই ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ গাজায়
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() গাজার চলমান খাদ্য সংকট ও আসন্ন দুর্ভিক্ষ কয়েকটি ধাপে তুলে ধরেছে আইপিসি। বলা হয়েছে, ইসরাইলের ‘ত্রাণ সহায়তা অবরোধ’ চলতে থাকলে ১১ মে থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে ভয়ংকর দুর্ভিক্ষের কবলে পড়বে পুরো গাজা। অসহায় জনপদে এখনই একবেলা-আধপেটা খেয়ে দিন পার করছে মানুষ। আবার এই সামান্য খাবারটুকুও জুটছে না কারও ভাগ্যে। আড়াই মাসেরও বেশি খাদ্য সরবরাহ বন্ধ থাকায় পরিস্থিটি এতটাই হৃদয়বিদারক যে— অবরুদ্ধ অঞ্চলটির প্রতি পাঁচজনের একজন অনাহারে থাকে। এছাড়াও তীব্র অপুষ্টিতে রয়েছে পাঁচ বছরের কম বয়সি প্রায় ৭১,০০০ শিশু। আল-জাজিরা, বিবিসি, এএফপি, সিএনএন, রয়টার্স। আইপিসি বলছে, বর্তমানে গাজার প্রায় দুই লাখ ৪৪ হাজার বাসিন্দা ভয়াবহ খাদ্যসংকটে। প্রতিবেদন অনুসারে, ১ এপ্রিল-১০ মে ২০২৫ সালের মধ্যে গাজার জনসংখ্যার ৯৩ শতাংশ তীব্র সংকটে (আইপিসি পর্যায় ৩) রয়েছে। এছাড়াও জনসংখ্যার ১২ শতাংশ আইপিসি পর্যায় ৫ (বিপর্যয়) এবং ৪৪ শতাংশ আইপিসি পর্যায় ৪ (জরুরি অবস্থা) রয়েছে। চলমান সংঘাতের কারণে গাজায় বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ খাদ্যসংকট চলছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গাজার খাদ্যসংকট নিয়ে এর আগে গত বছরের অক্টোবরেও একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল আইপিসি। সেই সময়ের কথা উল্লেখ করে তাদের সর্বশেষ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে গাজার খাদ্যসংকটে আরও বড় ধরনের বিপর্যয় নেমে এসেছে। খাদ্য ঘাটতি থাকায় আইপিসি রিপোর্টে ফেব্রুয়ারি থেকে মধ্য গাজার দেইর এল-বালাহ এবং দক্ষিণের খান ইউনিসে গমের আটার দাম ৩,০০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানকার মানুষের জীবনে বয়ে এনেছে চরম দুর্দশা। আইপিসির মূল্যায়নে উঠে এসেছে, গাজার ১৯ লাখ ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি, অর্থাৎ সেখানকার ৯৩ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন। ২ মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাহায্য অবরোধে ৮৫,০০০-এরও বেশি শিশুর তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের মধ্যে ২,৯০৯ জন শিশু মাঝারি অপুষ্টিতে এবং ৫৭৯ জন মারাত্মক অপুষ্টিতে রয়েছে। বৃহস্পতিবার ইউনিসেফের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা গেছে। এদিনে জাতিসংঘের মানবিকবিষয়ক অফিস (ওসিএইচএ) জানিয়েছে, গাজা উপত্যকায় তীব্র যুদ্ধে মৃত্যু, স্থানচ্যুতি এবং ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনছে। সামগ্রিকভাবে, গাজা উপত্যকার প্রায় ৭১ শতাংশ স্থানচ্যুতির ফলে খাদ্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্ল্যাসিফিকেশন (আইপিসি) অনুসারে, ২০২৫ সালের শুরুতে ৬০,০০০ শিশুর চিকিৎসার প্রয়োজন। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই ফলাফল দেখে তিনি উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে বেশির ভাগ শিশু ‘এখন চরম ক্ষুধার সম্মুখীন’— বিষয়টি তাকে বিমর্ষ করে তুলেছে। চরম এ খাদ্য ঘাটতির মূল কারণ তুলে ধরেছে জাতিসংঘের ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার (ফাও)। ১২ মে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, যুদ্ধের কারণে গাজার আবাদি জমি ধ্বংস হয়েছে। ফাও তথ্যানুযায়ী— গাজার ৭৫ শতাংশ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়াও অবরুদ্ধ অঞ্চলটির দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সেচ দেওয়ার জন্য কৃষি কূপ (মোট ১,৫৩১টি) ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) কান্ট্রি ডিরেক্টর আন্তোইন রেনার্ড বৃহস্পতিবার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে আমাদের জরুরি মজুত শেষ হয়ে গেছে, নিঃশেষ হয়ে গেছে। অপুষ্টির হার বাড়ছে। এটি পুরো শরীরকে দুর্বল করে তোলে এবং রোগের ঝুঁকিতে ফেলছে।’ এমন পরিস্থিতিতে ইসলামিক রিলিফ ওয়ার্ল্ডওয়াইড গাজায় খাদ্য সরবরাহ করতে পারছে না। দাতব্য সংস্থাটি ১৫ মে তাদের বিবৃতিতে বলেছে, ‘ইসরাইলের বাধায় গাজায় কোনো খাবার প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। কোনো ওষুধ নেই। হাসপাতাল এবং বেকারি চালু রাখার জন্য কোনো জ্বালানি নেই। এমনকি বাস্তুচ্যুত পরিবারের জন্য তাঁবু, আহত রোগীদের জন্য ব্যথানাশক ওষুধ বা নবজাতক শিশুদের জন্য ইনকিউবেটরও নেই। ছোট শিশুরা এখন ক্ষুধা ও রোগে মারা যাচ্ছে।’ তবে এ বিষয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসরাইল। তারা বলছে— গাজায় খাদ্যের ‘ঘাটতি নেই’ এবং ‘আসল সংকট হলো হামাস লুটপাট’। বৃহস্পতিবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার সাংবাদিকদের বলেছেন যে, গাজার একমাত্র দুর্ভিক্ষ ছিল ‘সত্যের দুর্ভিক্ষ’। অথচ শুক্রবার মধ্যপ্রাচ্য সফরের শেষ দিনে সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়ার আগ মুহূর্তে আবুধাবিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গাজায় খাদ্যসংকটের কথা স্বীকার করেছেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বলেছেন, ‘গাজার অসংখ্য মানুষ ক্ষুধার কবলে।’ পাশাপাশি ‘আগামী সপ্তাহে ভালো কিছু ঘটবে’ বলেও আশারবাণী শুনিয়েছেন তিনি। ‘চলাফেরার শক্তি নেই’ গাজার চলমান ক্ষুধা পরিস্থিতি নিয়ে সতর্কবার্তা দিয়েছেন দাতব্য প্রতিষ্ঠান নরওয়ের রিফিউজি কাউন্সিলের সহায়তা ব্যবস্থাপক সালমা আলতাওয়েল। গাজার মানুষদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মানুষের চোখে এখন পানি। তারা জানে না শিশু বা বয়স্কদের নিয়ে তারা কোথায় যাবে। চলাফেরার শক্তি নেই। তারা কেবল খুব ক্ষুধার্ত।’ ‘আমরা গাজায় মৃত’ দুর্ভিক্ষের বিষয়ে উম্ম আল-আবেদ আবু ওহেহ নামে এক নারী বলেন, ‘আমরা এমন কিছু চাই যা আমাদের সন্তানদের পেট ভরাতে পারে। আমরা গাজায় এখন মৃত।’ ‘খাদ্যের দাম হাস্যকর’ দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস শহরের পশ্চিমে অবস্থিত আল-মাওয়াসি থেকে কানাডিয়ান নার্স অ্যামি লো বলেন, ‘খাদ্যের দাম হাস্যকর। আমাদের ওষুধের পরিমাণ সীমিত রাখতে হচ্ছে কারণ আমাদের কাছে পর্যাপ্ত ওষুধ নেই। আমরা সাধারণত এক মাসের জন্য ওষুধ দিই কিন্তু এখন তা দিতে পারছি না।’ ‘একবেলা খাবার পাওয়া এখন সৌভাগ্য’ দাতব্য সংস্থা নরওয়ের রিফিউজি কাউন্সিলের সহায়তা ব্যবস্থাপক সালমা আলতাওয়েল বলেন, ‘যদি কেউ এখন দিনে একবেলা খাবার খায়, তাহলে তাকে ভাগ্যবান বলে মনে করা হয়। এটি কেবল কয়েকজনের সঙ্গেই ঘটছে না, এটি গাজার সবার সঙ্গেই ঘটছে।’ পশুখাদ্য পিষে রুটি গাজার নিরুপায় বাসিন্দারা এখন ডালের সঙ্গে পশুখাদ্য পিষে রুটি তৈরি করছে। আবু আবদুল্লাহ শতেউই বলেন, ‘আমাদের ক্ষুধা নিবারণের জন্য রুটি একমাত্র বিকল্প। শিশুদের ক্ষুধার্ত থাকা উচিত নয়। তারা কিছুই করেনি’। গাজা উপত্যকার উত্তরে জাবালিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত আলা হামুদা বলেন: ‘এ ধরনের রুটির গন্ধ খারাপ এবং স্বাদ তিক্ত। আমরা বেঁচে থাকার জন্য এ খাদ্য খেতে বাধ্য।’ খালি হাতেই ফিরল ইসমাইল খাবার বিতরণ কেন্দ্রে গিয়ে খালি হাতে ফিরে এলো ছয় বছর বয়সি ইসমাইল আবু ওদেহ। সে বলে, ‘খাবার আনতে গিয়েছিলাম কিন্তু কিছু পাইনি।’ যখন সে ভিড়ের মধ্য দিয়ে ধাক্কাধাক্কি করছিল, তখন খাবার তার মাথায় পড়ে যায় এবং কাঁদতে কাঁদতে ফিরে আসে। কেফায়া নামে এক বাসিন্দা বলেন, খাদ্যের অভাবের কারণে তার সন্তানরা ‘দুর্বল’ হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের কেনার মতো কিছুই নেই। বাজারটি খুব ব্যয়বহুল, তাই সেখানে পণ্য থাকলেও আমরা তা কিনতে পারি না।’ ‘আমার করের অর্থে শিশু হত্যা করা হচ্ছে’ গাজা যুদ্ধের আচরণে কিছু ইসরাইলি গভীরভাবে বিরক্ত। দাতব্য প্রতিষ্ঠান রোড টু রিকভারির প্রধান ইয়েল নয় বলেন, ‘আমি বিশ্বের কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে এখন এই যুদ্ধ বন্ধ করতে সাহায্য করুন। আমার কর এমন একটি যুদ্ধে ব্যয় করা হচ্ছে যেখানে হাজার হাজার শিশু নিহত হয়েছে।’ |