![]() নকশাবহির্ভূত রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স বাতিল, এরপর কী?
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() অভিযোগ আছে, এসব রেস্টুরেন্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবাসিক ভবন এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রমের অনুমতি নেই এমন ভবনে চালু করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় এমন অনেক রেস্টেুরেন্টে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে এবং সেসব ঘটনায় বহু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে। দুর্ঘটনার পর দেখা যায় সংশ্লিষ্ট ভবনে রেস্টুরেন্ট স্থাপনের অনুমতিই ছিল না। তখন শুরু হয় রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনের সমালোচনা। এ বিষয়ে এবার কিছুটা সজাগ হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। নিজেদের আওতাধীন এলাকায় আবাসিক ভবনে কোনো রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করতে দেবে না বলে সম্প্রতি জানিয়ে দিয়েছে সংস্থাটি। গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে তারা বলেছে, কিছু আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে রাজউক অনুমোদিত নকশার বাইরে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে এমননকিছু রেস্টুরেন্টে দুর্ঘটনায় সম্পদ ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। অনেকে অনৈতিক উপায়ে তথ্য গোপন করে কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করেছে। এমতাবস্থায় সম্পদ ও জানমালের ক্ষতির ঝুঁকি এড়াতে নকশা-বহির্ভূত সব রেস্টুরেন্ট এবং ভবনের ছাদে স্থাপিত রুফটপ রেস্টুরেন্টের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল ঘোষণা করা হলো। দ্য মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন (ট্যাক্সেশন) রুলস, ১৯৮৬ অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশন এলাকায় যেকোনো ধরনের ব্যবসা করতে হলে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় কয়েক হাজার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। তবে লাইসেন্স নিয়েছে মাত্র এক হাজার ২৬টি রেস্টুরেন্ট। বাকিগুলো সব অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। আবার যেসব ভবনে রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে, সেসবের বেশিরভাগের নকশায় রেস্টুরেন্টের অনুমোদন নেই। রেস্টুরেন্ট স্থাপনে লাগে ৮ প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন! বাংলাদেশ হোটেল ও রেস্টুরেন্ট আইন অনুযায়ী, রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করতে চাইলে সরকারের সাতটি সংস্থার, ক্ষেত্রবিশেষে আরও বেশি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন ও ছাড়পত্র নিতে হয়। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্রসহ নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে প্রথমে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করার জন্য নিবন্ধন করতে হয়। যাচাই-বাছাইয়ের পর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় লাইসেন্স প্রদান করে রেস্টুরেন্ট মালিককে। এরপর পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি কর্পোরেশন, সিভিল সার্জনের কার্যালয়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউটের (বিএসটিআই) অনুমোদন নিতে হয়। এছাড়া যে ভবনে রেস্টুরেন্ট করা হবে সেই ভবনের জন্য রাজউকের নকশায় রেস্টুরেন্ট বা বাণিজ্যিক ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ থাকতে হবে। তা না থাকলে সেই রেস্টুরেন্ট অবৈধ হিসেবে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে রাজউক। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত সব ঝামেলা থাকায় হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বাকি সব রেস্টুরেন্ট অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের ট্রেড লাইসেন্সও নেই, আবার অনেকে অবৈধভাবে সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে রেস্টুরেন্টের নামে শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। বাকি অনুমোদন বা ছাড়পত্র তাদের নেই। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এসব রেস্টুরেন্টের সবগুলোই কি বন্ধ হয়ে যাবে? সিটি কর্পোরেশন কীভাবে এত এত রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবে? এত জনবল বা সক্ষমতা কি আছে তাদের? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) থেকে সিটি কর্পোরেশনকে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে ডিএসসিসি। তবে লাইসেন্স বাতিল হওয়া এসব রেস্টুরেন্ট বন্ধ করা এবং এজন্য অভিযান পরিচালনা করা খুবই কঠিন কাজ। কারণ, কর্পোরেশনের সেই পরিমাণ জনবল নেই। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ সিটি এলাকায় ঠিক কতগুলো রেস্টুরেন্ট আছে তার সঠিক হিসাবও আমাদের কাছে নেই। এর জন্য আগে তালিকা তৈরি করতে হবে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ এবং কঠিন কাজ। তারপরও তালিকা প্রস্তুত করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে এবং পরবর্তী করণীয় কী হবে তা নিয়ে পরিকল্পনা চলছে। চাপে আছেন মালিকরা ট্রেড লাইসেন্স বাতিলের পর এক ধরনের চাপে আছেন রেস্টুরেন্ট মালিকরা। আগামীতে ব্যবসার কী হবে তা নিয়ে তারা শঙ্কিত। রাজধানীর খিলগাঁও এলাকার একটি রেস্টুরেন্টের মালিক হাবিবুর রহমান বলেন, অনেক ধার-দেনা করে ভবনে ডেকোরেশন করে, অগ্রিম টাকা সিকিউরিটি দিয়ে একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেছি। এখানে ১০ জনের কর্মসংস্থান হয়েছে। কিন্তু এখন সিটি কর্পোরেশন হঠাৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলে আমরা ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত। কী করব, কী করা উচিত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। হাজার হাজার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী এটা নিয়ে চিন্তিত। আমাদের অনেকের ট্রেড লাইসেন্স আছে, আবার অনেকের সেটাও নেই। আসলে রেস্টুরেন্টের অনুমোদন নেওয়া খুবই কঠিন এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যে কারণে এখানে অসাধু চক্র কাজ করে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য অনেকেই অনুমোদন ও ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসা করছে। তিনি বলেন, দু-একটি রেস্টুরেন্ট মালিক তাদের নিজস্ব ভবনে রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করেছে, কিন্তু আমাদের মতো সিংহভাগ রেস্টুরেন্ট মালিক ভাড়া ভবনে তাদের জীবনের সমস্ত সঞ্চয় বা ধার করে রেস্টুরেন্ট দিয়েছে। এখানে জায়গা একটা বড় বিষয়। ভবন মালিক রেস্টুরেন্টের জন্য অনুমোদন নিয়েছেন কি না এটা তাদের বিষয়। আমরা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হই এর দায় অন্য কেউ নিশ্চয়ই নেবে না। তাই আমরা চাই, বিচার-বিশ্লেষণ করে যেন সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যেন আমরা ব্যবসা করে পরিবার নিয়ে চলতে পারি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভবন মালিক বলেন, আমার ভবন আবাসিক, কিন্তু আমার এই ভবনে দুটি রেস্টুরেন্ট আছে। যখন ভবনের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে তখন রেস্টুরেন্টের জন্য অনুমোদন ছিল না। এখন আমাদের এলাকায় বলতে গেলে প্রতিটি ভবনেই দুই-চারটি রেস্টুরেন্ট আছে। অনুমোদন নেওয়া মানে রাজউককে একগাদা ঘুষ দেওয়া, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ঘুরে ঘুরে অসাধুদের ঘুষ দিয়ে ১৪ জায়গা থেকে অনুমোদন নেওয়া লাগে। স্বচ্ছ প্রক্রিয়া যদি থাকত তাহলে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যে নির্দিষ্ট ফি দিয়ে অনুমোদন আনতাম। কিন্তু প্রক্রিয়া তো অস্বচ্ছ! তিনি আরও বলেন, সিটি কর্পোরেশন রেস্টুরেন্টের লাইসেন্স বাতিল করেছে, কারণ তারা মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের ঘুষের ব্যবস্থা করতে চায়। এটা নিয়ে এখন এতটা চিন্তা করছি না। যখন অভিযান শুরু হবে তখন হয় আমার ভবনে রেস্টুরেন্ট বাতিল করে দেব, নয়তো অনুমোদন নেব। কী বলছে রেস্টুরেন্ট মালিক সমিতি লাইসেন্স বাতিলের সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক বলছেন রেস্টুরেন্ট মালিকরা। তারা বলছেন, এমন সিদ্ধান্ত রেস্টুরেন্ট খাতকে ধ্বংসের পাঁয়তারা ছাড়া কিছু নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, বর্তমানে একজন রেস্তোরাঁ মালিককে ব্যবসা শুরু করার জন্য বেশ কয়েকটি সংস্থার অনুমতি নিতে হয়। এই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফলে উদ্যোক্তারা প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন। তবুও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় আসছেন, যা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আমরা বহু বছর ধরে আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। এই সেক্টর কর্মসংস্থান, পর্যটন এবং জাতীয় অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। অনেক রেস্টুরেন্ট মালিক ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন, কিন্তু ডিএসসিসির এই সিদ্ধান্ত তাদের ঋণ পরিশোধে বাধা হবে। তিনি বলেন, সিটি কর্পোরেশনের এই সিদ্ধান্ত যদি অবিলম্বে প্রত্যাহার করা না হয় এবং দ্রুত আলোচনায় বসে সুষ্ঠু সমাধানে না আসে, তবে দেশের সব রেস্টুরেন্ট মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে আমরা কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করব। এই সিদ্ধান্তের ফলে রেস্টুরেন্ট মালিকদের বিনিয়োগের অবমূল্যায়ন হবে এবং হাজারো ব্যবসায়ী পথে বসবে। বিশেষ করে, যারা জায়গার লিজ বা রিনোভেশনে বিনিয়োগ করেছেন, তাদের জন্য এটি বিরাট আর্থিক সংকট সৃষ্টি করবে। লাইসেন্সবিহীন রেস্টুরেন্ট বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেছেন, ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে, এখন অবৈধ রেস্টুরেন্টগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা-পরিকল্পনা চলছে। যেকোনো সময় পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করব। প্রাথমিকভাবে যেসব রেস্টুরেন্ট সঠিক তথ্য না দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে সেগুলো বাতিল করা হয়েছে। ভবনের নকশায় রেস্টুরেন্টের অনুমোদন থাকলে সেই রেস্টুরেন্টের কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে তথ্য-উপাত্ত দিলে সেগুলো সচল হবে, তাদের কোনো সমস্যা হবে না। নগর পরিকল্পনাবিদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, কোন কোন ভবনে রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করা যাবে সেই নীতিমালা আরও স্পষ্ট করা জরুরি। রাজউক এবং সিটি কর্পোরেশনের উচিত শক্ত অবস্থানে গিয়ে অনিয়মের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করা। কোথায় আবাসিক ভবনের অনুমোদন, কোথায় বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন আছে সেগুলো নির্ধারণ করা এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা। |