![]() হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্ম অহমিকা বর্জনে হজের গুরুত্ব
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() হজের সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্রিত হয়। ভাষা-বর্ণের ভিন্নতা, সাংস্কৃতিক-জাতীয় পরিচয়ের পার্থক্য ও ভৌগোলিক দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব মুসলিমের ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত ও সুসংহত হয় পবিত্র হজ উদযাপনে। বিশ্ব মুসলিমের পারস্পরিক দুঃখ-অভাব, অভিযোগ-সমস্যা সম্পর্কে অবগত হওয়া ও তার সমাধানের সুযোগ হয় পবিত্র হজের বিশ্বসম্মেলনে। হজ গণতান্ত্রিক এক বিশ্ব সম্মেলন। এ সম্মেলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিম অংশগ্রহণ করতে পারেন। জাতিসংঘ- সহ বিশ্বের বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থার সম্মেলনে সংশ্লিষ্ট দেশ-জাতির নেতা ও প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। কিন্তু হজের সম্মেলনে বিশ্বের সর্বস্তরের মুসলিমের অংশগ্রহণের সুযোগ অবারিত। উঁচু-নিচু, ভাষা-বর্ণ, জাতি-গোত্র নির্বিশেষে বিশ্বের সামর্থ্যবান যে কোনো মুসলিমের নিঃশর্তভাবে হজ করার অধিকার ইসলাম সম্মত। হজ এক ধরনের দীর্ঘ সফর বা ভ্রমণ হলেও তা কোনো ভ্রমণবিলাস নয়। বরং এর মধ্যে লুকায়িত আছে মহান আল্লাহর প্রতি অগাধ আস্থা-আনুগত্য আর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা। নিজের উপার্জিত অর্থ ব্যয় এবং দৈহিক কষ্ট করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রচেষ্টা করা হয় পবিত্র হজে। মূলত হজ একটি অনন্য ইবাদত, যাতে সমন্বয় ঘটেছে আর্থিক ত্যাগ ও দৈহিক কসরত। এছাড়াও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও রাজনৈতিক সংহতিতেও হজের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। হজ মৌসুমে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোয় বিশেষত সৌদি আরবের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায়। এ সময় ব্যবসায়ী বিশ্ব মুসলিম নেতারা আলাপ-আলোচনা-চুক্তির মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধশালী করতে পারেন। অনুরূপভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত মুসলিম নেতারা পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান করতে পারেন। এতে বিশ্ব মুসলিম নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক সংহতি গড়ে উঠতে পারে। হজের সময় তারা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিশ্বমুসলিম সমাজ-সংস্কৃতিকে সুসংহত ও সমৃদ্ধ করতে পারেন। নির্যাতিত-নিপীড়িত-বঞ্চিত ও সাম্রাজ্যবাদীদের আধিপত্যের শিকার মুসলিম বিশ্বের জন্য হজ বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। হজ মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং অধিকার আদায়ের সুযোগ করে দেয়। হজ মৌসুমে মুসলিম বিশ্বের নেতারা বিভিন্ন মুসলিম দেশের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-মতভেদ নিরসনে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ছাড়া হজের বিশ্ব সম্মেলন থেকে মুসলিম নেতারা নিজেদের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আধিপত্যবাদীদের মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সুযোগ লাভ করেন। ইসলামের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদসহ প্রচারিত অন্যান্য অপবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বের করণীয় সম্পর্কে সঠিক দিকনির্দেশনাও দিতে পারেন তারা। আরাফাত ময়দানে অবস্থান হজের অন্যতম ফরজ কাজ। তবে এ অবস্থান নিছক অবস্থানই নয়। এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য সমবেত বিশ্ব মুসলিমের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে বিশ্বনেতাদের দিকনির্দেশনা দেয়া। মহানবী (সা.) বিদায় হজের সময় আরাফাত ময়দানে উপস্থিত মুসলিমদের উদ্দেশে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ের দিকনির্দেশনা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন এবং তার বক্তব্য অনুপস্থিতদের কাছে পৌঁছানোরও নির্দেশ দিয়েছেন। ঐতিহাসিকরা মহানবীর এ ভাষণকে বিদায় হজের ভাষণ নামে আখ্যায়িত করেছেন। পবিত্র কাবাঘর প্রদক্ষিণ, আরাফাত ময়দানে অবস্থান, সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যে দৌড়ানো, জামারায় পাথর নিক্ষেপ, আল্লাহর উদ্দেশ্যে পশু কোরবানি ইত্যাদি হজের আনুষ্ঠানিক ইবাদত। হজের এসব ইবাদত পারস্পরিক সম্পর্কিত হলেও এর প্রত্যেকটির মধ্যেই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব ঐতিহ্য। কাবাঘর প্রদক্ষিণ ও পশু কোরবানির মাধ্যমে হজরত ইব্রাহীম ও ইসমাইলের আদর্শ-ত্যাগের প্রতি প্রকাশিত হয় গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন। জামারায় পাথর নিক্ষেপের সাথে জড়িত আছে শয়তানের প্রতি বালক ইসমাইলের অবজ্ঞার নিদর্শন। আর সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে দৌড়ানোর মধ্যে নিহিত আছে শিশু ছেলে হজরত ইসমাইলের প্রতি বিবি হাজেরার ব্যাকুলতা স্মরণ। প্রকৃতপক্ষে হজ একটি ঐতিহ্যবাহী অনন্য ফরজ ইবাদত ও বিশ্ব মুসলিম সম্মেলন। ইসলামী পুনর্জাগরণের অন্যতম মাধ্যম হজ এবং কাবা। রমজান মাস যেমন সমগ্র মুসলিম জাহানে তাক্বওয়া-পরহেজগারির একটি অনন্য মৌসুম, ঠিক তেমনি হজও মুসলিম দুনিয়ায় ইসলামী জিন্দেগি ও জাগরণের এক মহা মূল্যবান মুহূর্ত। এটা কোনো অত্যুক্তি নয়, বরং শরী‘আত প্রণেতা কর্তৃক নির্দেশিত ইলাহী ব্যবস্থাপনা। দুনিয়ার অবস্থা যতই খারাপ হোক না কেন, কালের গতি যতই জটিল হোক না কেন, বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার-প্রসার এবং তার প্রতিষ্ঠা অব্যাহত গতিতেই চলতে থাকবে। মানব দেহে হৃদপিণ্ডের যে অবস্থান এবং গুরুত্ব, ঠিক তেমনি সমগ্র ইসলামী দুনিয়ায় কাবা ঘরের অবস্থান। মানব দেহের দিল যতদিন সক্রিয় থাকবে ততদিন নানা প্রকার রোগের আক্রমণে যতই দুর্বল আর শক্তিহীন হোক না কেন, সে যেমন মরে যাবে না, ঠিক তেমনি ইসলামী দুনিয়ায় এই দিলও প্রতি বছর দূর-দূরান্ত পর্যন্ত প্রসারিত ‘ধমনীর’ মাধ্যমে রক্ত শুষতে এবং তা আবার সমগ্র দেহে বিস্তার লাভ করতে থাকবে। যতদিন এ দিল সক্রিয় থাকবে এবং রক্তের এ প্রবাহধারা চলতে থাকবে, ততদিন সে দেহের জীবন শেষ হওয়া সম্ভব নয়, রোগ-ব্যাধিতে সে দেহ যতই ক্ষীণ, জর্জরিত ও দুর্বল হোক না কেন। পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ এক কথায় সমগ্র দিক হতে অগণিত জাতি এবং অসংখ্য দেশ হতে লাখ লাখ মানুষ হাজার হাজার মাইল পথ অতিক্রম করে একই কেন্দ্রের দিকে ছুটে আসছে। তাদের শারীরিক গঠন ও আকৃতি বিভিন্ন, বর্ণ বিভিন্ন, ভাষা বিভিন্ন কিন্তু কেন্দ্রের নিকটবর্তী এক নির্দিষ্ট স্থান পর্যন্ত পৌঁছেই নিজ নিজ জাতীয় পোশাক খুলে ফেলে এবং সবাই একই ধরনের পোশাক পরিধান করে। এভাবে দুনিয়ার হাজার হাজার জাতির মধ্য হতে লাখ লাখ তাওহীদী জনতা ছুটে এসে একই পদ্ধতিতে সালাত আদায় করে। সবার পোশাক এক, সবার একই ইমাম, একই গতিবিধি ও একই ভাষায় সালাত আদায় করে। এভাবে সমবেত লক্ষজনতার ভাষা, জাতি, দেশ, বংশ এবং গোত্রের কৃত্রিম বৈষম্য বিচূর্ণ হয়ে একাকার হয়ে যায়। এতে সমগ্র বিশ্বাসী মানুষের সমন্বয়ে যেন একটি বিরাট সম্মেলনের সৃষ্টি হয়। তারপর এ বিশাল আন্তর্জাতিক ঐক্য যখন পথের প্রত্যেক চড়াই-উৎরাইয়ে একই ‘লাব্বাইক’ ধ্বনিতে এগিয়ে চলে, তখন এক আশ্চর্য পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সে পরিবেশে মানুষ নিজেকে ভুলে গিয়ে এক অচিন্তনীয় ভাবধারায় মত্ত হয়ে পড়ে। এসব কাজে যে পবিত্র পরিবেশ ও আধ্যাত্মিক মনোভাবের সৃষ্টি হয়, দুনিয়ার অন্য কোনো ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থায় তার তুলনা নেই। এ উদ্দেশ্য ও অনুভূতি সামনে রেখে হজ উদযাপন করলে একদিকে যেমন ব্যক্তিগতভাবে উন্নত চরিত্রের মানুষ হওয়া যাবে, অন্যদিকে মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সম্পর্ক দৃঢ় ও অটুট হওয়ার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠার কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন সহজ হবে। হজ সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বজনীন মানবতা বিকাশের অন্যতম একটি মাধ্যম। সারা জীবনব্যাপী কষ্টার্জিত অর্থে যে নিরাপদ আশ্রয় গড়ে তোলা হয়, আনন্দ-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, স্ত্রী-পুত্র-কন্যাসহ নিকটাত্মীয়দের সঙ্গে যে নিবিড় মায়াময় সম্পর্কের সৃষ্টি হয়, একমাত্র আল্লাহর মহব্বতে সে সবকিছুর মায়া-বন্ধন ছিন্ন করে ‘লাব্বাইক’ অর্থাৎ ‘আমি আমার মহান প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে পড়েছি’ উচ্চারণ করে দীর্ঘ পথের ক্লান্তি, সফরের সীমাহীন তাকলীফ সহ্য করে আল্লাহর ঘরে উপনীত হতে হয়। এভাবে হজ সমাপন করে যখন কেউ ঘরে ফিরে আসে, তখন তার অবস্থা সদ্যজাত মাছুম শিশুর মতোই হয়ে যায়। দুনিয়ার লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, পঙ্কিল-আবিলতা তাকে স্পর্শ করতে পারে না। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে হজের দ্বারা যে চারিত্রিক উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটে, তা মানুষকে আশরাফুল মাখলুক্বাতের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এর কার্যকর ভূমিকা সত্যিই বাস্তবিক। ইহরাম বেঁধে ‘লাব্বাইক’ বলে যখন হারাম শরিফের চতুর্দিক থেকে মানুষ ছুটে আসে এবং বায়তুল্লাহ শরিফ ত্বাওয়াফ করতে থাকে, তখন ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র সব ভেদাভেদ লোপ পায়। যে মহান স্রষ্টা আসমান-জমিন, জিন-ইনসান তথা সমস্ত জগৎ ও মাখলুক্বাতের স্রষ্টা, যিনি আমাদের ইহ-পরকালের একমাত্র প্রভু, তার ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানে হাজির হওয়ার পর দুনিয়ায় প্রচলিত মানুষের মনগড়া কৃত্রিম ভেদাভেদের কথা কখনও মনে স্থান পায় না। হিংসা-বিদ্বেষ ও আত্ম অহমিকা বর্জনে হজের প্রভাব সত্যিই আশ্চর্যজনক। ভাষা, বর্ণ, গোত্র, সংস্কৃতি ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও সবাই যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই ভাই হয়ে বিশ্ব জাহানের পালনকর্তা মহান প্রভু আল্লাহর দরবারে হাজির হওয়ার আগ্রহে ব্যাকুল। নিজেদের যাবতীয় গুনাহ মাফ করিয়ে নেয়ার চূড়ান্ত ব্যস্ততা। সত্যি এক অকল্পনীয় ও অচিন্তনীয় দৃশ্য। তাই মুসলিম বিশ্বের কাছে হজের গুরুত্ব সত্যিই অবর্ণনীয়। লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক |