![]() রাজধানীবাসীর নিত্যসঙ্গী বায়ুদূষণ, উত্তরণ কোন পথে?
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() শিল্প-কারখানার নির্গমন, যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণকাজের বালু-ধুলা আর অধিক জনসংখ্যার ফলে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে দেশের বায়ুমান। ঢাকায় যা অসহনীয় পর্যায়ে। এতে শ্বাসকষ্ট, ক্যানসার, হৃদরোগসহ নানান জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে সব বয়সী মানুষ। সঠিক পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাবে দূষিত বাতাসে শ্বাস নিচ্ছে কোটি মানুষ। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ ৭৩ হাজার মানুষ বায়ুদূষণজনিত কারণে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এর মধ্যে মৃত্যু বেশি ঢাকায়। আন্তর্জাতিক বায়ুমান সূচক অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বাতাসের মান ‘অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর’ থাকছে প্রতিনিয়ত। দূষণ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের জানুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় ২৪ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আট বছরের (২০১৭-২৪) জানুয়ারি মাসের গড় দূষণের মান ছিল ২৫৫ দশমিক ৪৮। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা ছিল ৩১৮। আগের বছরের জানুয়ারিতে এটি ছিল ৩০২। বিগত ৯ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস বায়ুদূষণের দিক থেকে ছিল শীর্ষে। এছাড়া ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের বায়ুদূষণ আগের আট বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের গড় মানের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ বেশি ছিল। ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার বায়ুর মান ছিল ২৬২। এটি ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে এর মান ছিল ২৫৮। কেন এত দূষণ? জানা যায়, বায়ুদূষণের প্রাকৃতিক কারণগুলোর মধ্যে আবহাওয়াজনিত ও ভৌগোলিক কারণগুলো অন্যতম। পাশাপাশি মানবসৃষ্ট কারণগুলোর মধ্যে নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি, আইনের দুর্বলতা, আইন প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা ও আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবকে অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশ অধিদপ্তর (ডিওই) এবং বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের গবেষণা থেকে জানা যায়, ৫৮ শতাংশ পিএম ২.৫ (অতিক্ষুদ্র বস্তুকণার উপাদান) আসে ইটভাটা থেকে, ১৮ শতাংশ আসে যানবাহন থেকে, ১০ শতাংশ আসে নির্মাণকাজের ধুলা থেকে এবং ১৪ শতাংশ আসে বর্জ্য পোড়ানো, জৈব জ্বালানি ও শিল্প থেকে। এই দূষণ সার্বক্ষণিক তৈরি হচ্ছে। ক্যাপস বলছে, অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এবং নির্মাণকাজ, ইটভাটা ও শিল্প-কারখানা, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, আন্তঃদেশীয় বায়ুদূষণ, গৃহস্থালি ও রান্নার চুলা থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং বর্জ্য পোড়ানোর কারণে বায়ুদূষণ হয়। ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড বিশ্বিবদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কামরুজ্জামান বলেন, ‘শহরের অধিকাংশ বাস ও ট্রাক এখনো পুরোনো, কালো ধোঁয়া নির্গত করে। রাজধানী ও আশপাশে প্রায় দুই হাজারেরও বেশি ইটভাটা, যার অধিকাংশই অবৈধ ও পরিবেশবিধি না মানা। ভবন নির্মাণ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে ধুলা বাতাসে মিশছে। এছাড়া অনেকেই খোলা জায়গায় প্লাস্টিক, পলিথিনসহ বিভিন্ন আবর্জনা পোড়ান, যা সরাসরি বিষাক্ত গ্যাস ছাড়ে।’ বায়ুদূষণে বেশি ঝুঁকিতে যারা শিশু, বৃদ্ধ, গর্ভবতী নারী ও ফুসফুসের রোগীরা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন। হাসপাতালগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শীতকালে নিউমোনিয়া, হাঁপানি, কাশি ও ফুসফুসের রোগীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। শ্যামলীর ২৫০ শয্যা টিবি হাসপাতালের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে আউটডোরে রোগী ছিল ৮ হাজার ৬১১ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে তা বেড়ে হয় ৯ হাজার ৬১৫ জন। মার্চে দূষণ কমলেও রোগীর সংখ্যা খুব একটা কমেনি, এ মাসে ৮ হাজার ৯৪৯ জন রোগী চিকিৎসা নেন। এপ্রিল মাসে হাসপাতালে যান ৭ হাজার ৮৬৫ জন রোগী। গত সোমবার টিবি হাসপাতালের সামনে কথা হয় শ্বাসকষ্টের রোগী বিজয় তালুকদারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার বয়স এখন ২৬-এর ঘরে। তিন বছর ধরে ইনহেলার নিচ্ছি। শ্বাসকষ্ট ও ফুসফুসের সমস্যা বেশি। ইনহেলার ছাড়া বের হতে পারি না। এখন মাস্ক পরেই চলি। তবু নিস্তার পাই না।’ শ্যামলী টিবি হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার বলেন, ‘ঢাকায় বৃষ্টির মৌসুম ছাড়া প্রায় সব সময়ই বাতাস দূষিত হচ্ছে। অন্য মৌসুমের চেয়ে শীত মৌসুমে রোগী বেড়ে যায় দ্বিগুণের বেশি। এবছর মার্চ-এপ্রিল মাসেও রোগীর সংখ্যা অনেক। প্রতিদিন এখন গড়ে ৩শ রোগী আসছে আউটডোরে। শুষ্ক মৌসুমে রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় দৈনিক চার থেকে পাঁচশ।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকা দূষণের দিক দিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে। দূষণের জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। আমাদের সব সময় পরামর্শ থাকে, নাক-মুখ ঢেকে বা মাস্ক পরে বাইরে যেতে হবে। তাহলে দূষণ থেকে দূরে থাকা যায়।’ দূষণ বেশি কোথায়? ক্যাপস তাদের গবেষণায় জানায়, জেলাভিত্তিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের জেলা গাজীপুর। এ জেলার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্ধারিত মানমাত্রার চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। সবচেয়ে কম দূষিত বাতাসের জেলা সিলেট। যদিও সিলেট শহরের বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা ডব্লিউএইচওর মানমাত্রার চেয়ে ৯ দশমিক ৭ গুণ বেশি। এমনকি এটা বাংলাদেশের নির্ধারিত জাতীয় আদর্শ (বার্ষিক) মানের চেয়ে ৩ দশমিক ২৩ গুণ বেশি। সরকারের পদক্ষেপ পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ঢাকার চারপাশের অবৈধ ইটভাটাগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলমান। পাশাপাশি নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পানি ছিটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বায়ুমান ব্যবস্থাপক) জিয়াউল হক বলেন, ‘এটা দীর্ঘদিনের সমস্যা। আবার আমাদেরও চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সমস্যা হলো নির্মাণাধীন স্থান ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে আইন মানছে না। আমাদের এনফোর্সমেন্ট বিভাগের অভিযান চলছে। ফলাফল আসতে একটু দেরি হবে। আমাদের কিছু প্রজেক্ট চলমান, রাস্তার ডিভাইডারের মধ্যে ঘাস ও গাছ লাগানো শুরু হয়েছে। টাস্কফোর্স নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছে। যার ফলাফল আমরা আগামী শুষ্ক মৌসুমের আগে পাবো।’ তবে পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা বলছেন, শুধু অভিযান নয়, দূষণ রোধে টেকসই পরিকল্পনা ও কড়া আইন প্রয়োগ করতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবীর বলেন, ‘দূষণের এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসবো জানি না। তাই আইনের প্রয়োগটা সবচেয়ে বেশি জরুরি। ফিটনেসবিহীন গাড়ি একদম তুলে দিতে হবে। ইলেকট্রিক গাড়ি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব। যেমন সাইকেলের ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। এতে শহরে শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ রোধ হবে। এজন্য আলাদা লেন জরুরি। কিন্তু আমাদের সেটা নেই। প্রশাসন নানান উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সমাধান হয় না। কারণ আমরা দূষণের উৎস বন্ধ করতে পারি না।’ সমাধানের উপায় কী? গত ২২ এপ্রিল বিশ্ব ধরিত্রীর দিবস উপলক্ষে বাপা এক সংবাদ সম্মেলনে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে কিছু সুপারিশ করে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করে বৈদ্যুতিক এবং হাইব্রিড যানবাহনের ব্যবহার বাড়ানো, ব্লক ইট উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ, বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা, বিদ্যমান জ্বালানি নীতিগুলোতে সংশোধন আনা, নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প-কারখানায় বিশ্বমানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নিঃসরণ মান নির্ধারণ এবং এর কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার প্রস্তাব দেয় সংগঠনটি। বায়ুদূষণ কমাবে পরিবেশবান্ধব যানবাহন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কার্যকর পদেক্ষেপের অভাব সবচেয়ে বেশি। প্রশাসন গোল (লক্ষ্য) সেট করে না। এখন এয়ার পিউরিফায়ার আনবে, এটা দিয়ে ঠিক কতটা দূষণ দূর করবো সেই লক্ষ্য আমাদের নেই।’ তিনি বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যদি টার্গেট নেয়, যে আমরা এতগুলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি উঠিয়ে দেবো, আবার এতগুলো পরিবেশবান্ধব গাড়ি চালু করবো- এরকম টার্গেট আমাদের নেওয়া হয় না। ব্যক্তিগত গাড়ি থেকে শুরু করে গণপরিবহন, প্রতিটি সেক্টরে আলাদা টার্গেট নিতে হবে। কোন কারখানা থেকে কতটা দূষণ কমাবো- এসব প্ল্যান না নিলে দূষণ কমবে না।’ এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও বলেন, ‘আমাদের প্রশাসনের দায়িত্বশীলরা সত্যিকারভাবে আসলেই ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধ করবে কি না, দূষণের সোর্স বন্ধ করবে কি না, কোন বছর কতটুকু দূষণ কমাবে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।’ সাধারণ মানুষকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল সরকার নয়, নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। ঘর থেকে বের হলে মাস্ক পরা, বাড়িতে গাছ লাগাতে হবে। যত্রতত্র বর্জ্য না ফেলা, বর্জ্য না পোড়ানো থেকে বিরত থাকতে হবে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আবু ফয়সাল জামিল বলেন, ‘দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের অপারগতা দীর্ঘদিন থেকে দেখছি। এখন যেটা জরুরি সেটা হলো আমাদের দেশের মানুষকে সতর্ক হতে হবে। প্রতিটি মানুষ রাস্তায় বের হলেই মাস্ক পরতে হবে বাধ্যতামূলক। না হলে এই দূষণ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। মাস্ক পরার জন্য স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করতে হবে। মানুষের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। দরকার হলে মাস্ক পরার বিষয়ে শাস্তি বা আইনের বিধান রাখতে হবে।’ |