![]() তোমরা হেরে গেলে, হেরে যাবে বাংলাদেশ
রায়হান আহমেদ তপাদার:
|
![]() বিপরীত দিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ, কথা ও বিবৃতি, অফুরন্ত কর্মস্পৃহা মানুষের মধ্যে, শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষত বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ক্রমে বাড়ছে। কারণ, তারা এ রকম উজ্জ্বল নেতৃত্ব গত কয়েক দশকে দেখেনি। তাই তারা এখন তুলনা করতে পারছে। শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের ভাবনায় ফুটে উঠছে, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে এত প্রাণহানির পর মানুষ আর পেশিশক্তিনির্ভর, সন্ত্রাসনির্ভর, চাঁদাবাজি নির্ভর রাজনীতি দেখতে চায় না। তারা সন্ত্রাসী, চাটুকার পরিবেষ্টিত রাজনীতিবিদদের গলাবাজি শুনতে চায় না। তারা দেখতে চায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নতি, অর্থনীতিতে গতি, বাজারের স্থিতিশীল অবস্থা, ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা। অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে,রাজনীতিকরা কেউ কেউ অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছেন! এমনকি কোনো কোনো রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে এখন ‘অনির্বাচিত’ আখ্যা দিচ্ছে। যদিও নাগরিকদের বড় অংশ এই সরকারের ওপরেই আস্থা রাখছে। নাগরিকদের ধারণা জন্মেছে, সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক দল রাষ্ট্র পরিচালনায় আসবে, রাষ্ট্র সংস্কারে তাদের ইচ্ছা বা সক্ষমতার ঘাটতি আছে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরেও গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রকট। যদিও রাজনৈতিক দলগুলো এর কারণ খোঁজায় খুব আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগবিহীন রাজনৈতিক পরিবেশে বর্তমানে বিএনপির ভালো অবস্থানে থাকার কথা। কিন্তু তারা দৃশ্যত চাপের মধ্যে। এমনকি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও মানুষের একচেটিয়া সমর্থন পাচ্ছে, বলা যাবে না। তার মানে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট সমর্থক গোষ্ঠী ছাড়া সাধারণ নাগরিকরা রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। বিপরীতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি নাগরিকদের আস্থা ক্রমেই বাড়ছে। এটা স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর মানুষের আস্থা আরও বাড়তে থাকবে। অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো রাজনীতিতে গুণগত সংস্কার আনতে না পারলে দলীয় কর্মী-সমর্থকের বাইরে সাধারণ নাগরিকদের সমর্থন কমতে থাকবে। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখনও সেকেলে ধাঁচের ব্যক্তি-তোষণ, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি চালু আছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো অভ্যন্তরীণ সংস্কার। দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। নেতাকর্মীর বক্তব্যে সুস্থ ধারার রাজনীতির ছাপ থাকতে হবে। তারা ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে কীভাবে ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ হিসেবে গড়ে তুলতে চান, তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। রাজনীতির প্যাটার্নই বদলাতে হবে। বস্তুত পুরোনো রাজনৈতিক দলের নেতারা এখনও নব্বই দশকের রাজনীতি করছেন। তাদের বয়ানের মধ্যে কোনো নতুনত্ব নেই। তাদের বক্তব্য সচেতন নাগরিকরাও সেভাবে শুনছেন না। বিএনপি বা জামায়াতের প্রথম সারির নেতাদের রাষ্ট্র গঠন নিয়ে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক ভাবনা শোনা যায় না। এমনকি বিএনপির ৩১ দফাও নিজ দলের মধ্যে আলোচনায় আসছে না সেভাবে। আবার সরকারের বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার প্রশ্নে অনেক জরুরি বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারছে না। এটি রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতাই বটে। তরুণ প্রজন্মের কাছে এই রাজনীতি কোনো আকর্ষণ তৈরি করছে না।ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন ও পলায়নের পর আওয়ামী লীগ নেতাদের নিরাপদ আশ্রয় এখন কলকাতা। সেখানে তারা লুটের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করছেন। অন্যদিকে দিল্লিতে বসে হাসিনা অডিও বার্তায় হুংকার ছাড়ছেন, তিনি বসে নেই। নেতাকর্মীদের রাস্তায় নামার জন্য নানাভাবে উসকানি দিচ্ছেন। এমনকি পাল্টা আঘাত হানার ডাক দিয়েছেন। নিজেকে আড়াল করে হাসিনার দেওয়া অডিও বার্তাগুলো বেশ রহস্যময়। তবে হাসিনা কথা বন্ধ করার মানুষ নন। দেড় দশকের শাসনে গুম, খুন ও নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তার লাগামহীন মুখের কথা এ দেশের মানুষের মনে গেঁথে আছে তীরের মতো। তার সেই স্বভাব এখনো অটুট। তবে, এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় অডিও বার্তায় তার যেসব কথা শোনা যাচ্ছে, তাতে দুই হাজার মানুষের মৃত্যু ও প্রায় ২০ হাজার মানুষকে পঙ্গু করা নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই। নিজ দলের নেতাকর্মীদের বিপদে ফেলে পালিয়ে যাওয়া নিয়ে কোনো লাজ-শরমও নেই। পালানোর ৭২ ঘণ্টা আগেও নিজেই বলেছিলেন, শেখ হাসিনা পালায় না। মজার ব্যাপার হলো, তিনি যখন ছাত্রদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে টেলিভিশনের সামনে বাগাড়ম্বর করছেন, তখন শেখ পরিবারের সব সদস্যকে দেশ ছেড়ে পালানোর ব্যবস্থা করেছেন। এখন পর্যন্ত শেখ হাসিনার পরিবার বা আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজনও পাকড়াও হয়নি। লুটের বিপুল অর্থের অধিকারী তার স্বজন ও হার্ডকোরের সদস্যরা বিদেশে মোজমাস্তিতে বেশ সুখী জীবনযাপন করছেন। আর শেখ হাসিনা ভারতের সমর্থন নিয়ে প্রতিশোধস্পৃহা থেকে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন। পলাতক নেতারা দেশকে অস্থির করতে বিপুল অর্থ খরচ করছেন। আবেগি কিছু কর্মী-সমর্থককে টোকা দিচ্ছেন মাঠে নামতে। এর লক্ষ্য, তারা মাঠে নামুক, ইস্যু তৈরি হোক।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আসলে শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দিয়ে তারপর তার মাধ্যমে ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে উসকানি দিতে চাইছে, এটা যাতে কেউ বলতে না পারে, সে জন্যই দিল্লির এই সতর্ক অবস্থান! আর যেহেতু শেখ হাসিনার নিজস্ব কোনো ভেরিফায়েড ফেসবুক বা এক্স অ্যাকাউন্টও নেই, ফলে এটাও দিল্লির স্বস্তির একটি কারণ যে, সেখানেও তার কোনো পোস্ট আসছে না! কিন্তু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক পুনর্বাসন কি আদৌ সম্ভব? এই অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টা নিয়ে দিল্লি কী ভাবছে? গত আট মাসে শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ফোনালাপের বিষয়ে ভারত সরকারিভাবে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি। বাংলাদেশ থেকে ভারতকে বারবার বলা হচ্ছে, শেখ হাসিানাকে সংবরণ করাতে। এতে দুদেশের সম্পর্কের ক্রমাবনতি হচ্ছে। ভারত এর কোনো জবাব দেয় না। কিন্তু, গোলমাল যা বাঁধার তা হয়ে চলছে। একই সাথে ভারতকেও বাংলাদেশ ও সমসাময়িক বিশ্বের বাস্তবতা বুঝতে হবে। ছড়ি ঘোরানোর প্রবণতা ছেড়ে সহযোগিতার হাত বাড়ানোতেই সবার মঙ্গল। বাংলাদেশকে একটি জাতি রাষ্ট্র বলা হলেও দেশটি কিন্তু এক জাতির নয়। পাঁচই আগস্টের বিক্ষোভ মিছিলে শুধু এক চিন্তা, বিশ্বাস, ধর্ম এবং দলের মানুষ ছিল না। নানা শ্রেণি, পেশা, বিশ্বাসের কম্বিনেশন ছিল সেই দিনের রাজপথে। সুতরাং সেই দিন মিছিলে যাওয়া মানুষ গুলো যে স্বপ্ন, সম্ভাবনা এবং প্রত্যাশা-এগুলোই জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি মূলমন্ত্র হওয়া উচিত এবং তাই হতে হবে। নতুন দিনের রাজনীতি মুক্তিকামী মানুষের স্লোগানের ভাষাকে ধারণ করতে হবে, দেয়াল দেয়ালে লিখা মুক্তির পঙক্তি মালাকে বরণ করতে হবে। নতুন দিনের রাজনীতি হতে হবে 'নিট এন্ড ক্লিন'। রাজনীতিকে রাজনীতির লাল ফিতার দৌরাত্ম থেকে মুক্ত করে গণ মানুষের সমস্যা সমাধানের কারণ হয়ে উঠতে হবে। একটা ফ্যাসিস্ট সরকারকে হঠাতে এই যে লাখ লাখ মানুষ রাজপথে নেমে আসলো, তাদের চাওয়াটা কী? প্রত্যাশা কী? যে মানুষটার রাষ্ট্রের কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে যাওয়ার প্রত্যাশা নেই, কোনো দিন রাজনীতি করে নাই,করবেও না কিন্তু জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল, সে কী চায়? জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে এইসব প্রশ্নের জবাব থাকতে হবে। না হয় সব তত্ত্ব এবং তথ্যই ব্যর্থতায় নিমজ্জিত হবে। তাইতো বলি 'তোমরা হেরে গেলে, হেরে যাবে বাংলাদেশ'। লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট |