/ সারাদেশ / চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের শঙ্কায় স্বতন্ত্ররা
নৌকার প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার দুরভিসন্ধি করা হলে খেসারত দিতে হবে পুরো দেশকে -সুজন চট্টগ্রাম সভাপতি
চট্টগ্রামে ষড়যন্ত্রের শঙ্কায় স্বতন্ত্ররা
নতুন বার্তা, চট্টগ্রাম:
|
চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি আসনে নির্বাচন বানচাল ও কেন্দ্র দখলে ষড়যন্ত্র চলছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্বতন্ত্র প্রার্খীরা। প্রচারের শুরু থেকেই এসব আসনে নৌকার প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। যেখানেই প্রচারণার জন্য যাচ্ছেন সেখানেই তাদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। ভাঙচুর করা হচ্ছে ক্যাম্প, প্রচারণার গাড়ি। ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে ব্যানার-পোস্টার। এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকের বাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ার ঘটনাও ঘটছে। এ অবস্থায় নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে সরকার ও নির্বাচন কমিশন যে অঙ্গীকার করেছে এর বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে কি না তা নিয়েও সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে। চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের মধ্যে অন্তত ৭টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে পটিয়া, চন্দনাইশ, বাঁশখালী, বোয়ালখালী, ডবলমুরিং ও বন্দর-পতেঙ্গা আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী নৌকার প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তারা বলছেন, এমনিতেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। দলটি ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছে। মাঠে আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী ও নৌকার মনোনয়নবঞ্চিত হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই এখন সরব। কোনো কোনো আসনে নৌকার প্রার্থীর চেয়ে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতির জন্য নিয়ামক তারাই। পাশাপাশি ছোটখাটো বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মাঠে থাকলেও ভোটার উপস্থিত করার ক্ষেত্রে তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারবে না। এ অবস্থায় নৌকার প্রভাবে যারা এখন থেকেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে তাতে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। এ আতঙ্কের পরিবেশ যদি ভোটের দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে তবে ভোট উৎসব মাঠে মারা যাবে। কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিত হবে না। আবারও একতরফা নির্বাচনের ‘অভিযোগ’ বয়ে বেড়াতে হবে সরকারকে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন উঠলে সেই সরকারের টিকে থাকার বিষয়টিও সুদূরপরাহত হয়ে যাবে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভোটাররা কেন্দ্রমুখী না। বিএনপিকে বাদ দিয়ে যে নির্বাচন বর্তমানে হচ্ছে সেই নির্বাচন এমনিতেও প্রশ্নবিদ্ধ। এরপরও আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মাঠে থাকায় কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি হবে-এমন আশা ছিল। কিন্তু যেভাবে প্রচারের শুরু থেকেই বিভিন্ন আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ওপর হামলা হচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে সেই আশায়ও ‘গুড়েবালি।’ তিনি বলেন, ‘নৌকার প্রার্থীরা ভাবছে সরকার তাদের পক্ষে, প্রশাসন তাদের পক্ষে-মূলত এ ভাবনা থেকেই তারা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চেপে ধরার চেষ্টা করছে। ভোটের পরিবর্তে ভোটের দিন নিজেদের পক্ষে ফল ঘোষণা করানোর ‘চক্রান্ত’ ও ‘ষড়যন্ত্র’ করছে। কার্যত বর্তমানে বেশিরভাগ আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এ প্রতিযোগিতায়ও যদি যোগ্য বা জনপ্রিয় প্রার্থীদের উঠে আসার সুযোগ দেওয়া না হয়, সুষ্ঠু ভোট না হয়, নৌকার প্রভাব খাটিয়ে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিঁড়ে নৌকার প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার দুরভিসন্ধি করা হয়, তবে তার খেসারত দিতে হবে পুরো দেশকে। এটা কেউ মেনে নেবে না।’ চট্টগ্রাম-১০ (ডবলমুরিং) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক সিটি মেয়র এম মনজুর আলমের (ফুলকপি) প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী মোহাম্মদ শামসুদ্দোহা বলেন, ‘নৌকা প্রার্থীর অনুসারীরা প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই আমাদের প্রচার-প্রচারণায় বাধা দিচ্ছেন। ক্যাম্প ভাঙচুর করছেন। হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় এ ধরনের ঘটনার অভিযোগে আমরা থানায় জিডি করেছি। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি অভিযোগ যাচাই-বাছাই করে জড়িতদের চিহ্নিত করে দ্রুত যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তবে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে। পাশাপাশি সরকার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোটের মাধ্যমে জনরায় প্রতিফলনের যে উদ্যোগ নিয়েছে তা মাঠে মারা যাবে।’ এ আসনে নৌকার প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন মো. মহিউদ্দিন বাচ্চু। চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে নৌকার প্রার্থী মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতার অভিযোগ এনেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (ঈগল) হুইপ সামশুল হক চৌধুরী। বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি অভিযোগ করে বলেছেন, ‘আমার জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে নৌকার প্রার্থী মোতাহের সন্ত্রাসীদের দলে ভিড়িয়ে হামলা, নির্যাতনের মাধ্যমে পটিয়ার নির্বাচনি পরিবেশ বিনষ্ট করার অপচেষ্টায় মেতে উঠেছেন। প্রচারণার শুরুর দিন থেকেই আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা, ক্যাম্প ভাঙচুর, বহরের গাড়ির চাকা কেটে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছেন।’ এ অবস্থায় সুষ্ঠু ভোট হতে না দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে এবং ভোটের পরিবর্তে ফল ঘোষণা করে জনরায় ছিনিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আঁটছে কিনা সেই সন্দেহ তিনি উড়িয়ে দিচ্ছেন না। চট্টগ্রাম-১৫ (লোহাগাড়া-সাতকানিয়া আংশিক) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এমএ মোতালেবের সমর্থক এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে নৌকা প্রতীকের স্লোগান দিয়ে গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। বুধবার গভীর রাতে সাতকানিয়া উপজেলার পশ্চিম ঢেমশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রিদোয়ানুল ইসলাম সুমনের বাড়ি লক্ষ্য করে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় দুর্বৃত্তরা মোতালেবের প্রচার কাজে ব্যবহৃত একটি মাইক্রোবাস, পুলিশ পরিবহণে নিয়োজিত সিএনজি চালিত অটোরিকশা ও নির্বাচনি অফিস ভাঙচুর করে। মোতালেবের প্রধান নির্বাচন সমন্বয়কারী ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘আমাদের প্রার্থী নৌকা বা আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ নন। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। কেবল নির্বাচনে প্রতীকটা ভিন্ন। সুষ্ঠু নির্বাচনে জনপ্রিয়তা যাচাই-ই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য। কিন্তু যেভাবে নৌকার প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা বাধা প্রদানে নেমেছে তাতে আমরা শঙ্কিত সুষ্ঠু ভোট নিয়ে। বাঁশখালীতেও নৌকা প্রার্থীর অনুসারীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মুজিবুর রহমান ও আবদুল্লাহ কবির লিটনের অনুসারীরা। এ ব্যাপারে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক ও জেলার রিটার্নিং কর্মকর্তা আবুল বাসার মুহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘নৌকার প্রার্থীদের দ্বারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও তাদের অনুসারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন; তাদের ক্যাম্প-গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে, প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়া হচ্ছে-এমন অভিযোগ বেশি পাচ্ছি। আর এটি অব্যাহত থাকলে কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি কম হবে সেটিও আমাদের বিবেচনায় আছে। মূলত এ জন্য সংশ্লিষ্ট আসনের প্রার্থীদের আমরা শনিবার ডেকে কড়া বার্তা দিয়েছি। এ ধরনের হামলায় জড়িতদের চিহ্নিত করে এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। ম্যাজিস্ট্রেট ও ইলেক্টোরাল অনুসন্ধান কমিটিকে আরও তৎপর হতে বলা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হলে কেন্দ্রে অবশ্যই ভোটার যাবেন এবং আমরা সেই ফিল্ড তৈরির জন্য যা যা করার তাই করব।’ |