/ সারাদেশ / ডিবি'র বক্তব্য ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়: ফরহাদ মজহার (ভিডিও)
ডিবি'র বক্তব্য ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়: ফরহাদ মজহার (ভিডিও)
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
কবি ও কলামিস্ট ফরহাদ মজহারকে উদ্ধারের পর র্যাবকে বন্দুক দেখিয়ে ফের তাকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল সাদা পোশাকের কয়েকজন ব্যক্তি। শনিবার রাতে নিজ বাসায় করা সংবাদ সম্মেলনে এমন তথ্য জানিয়েছেন তিনি নিজেই। শনিবার রাতে শ্যামলীতে নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা জানান। অপহরণের ঘটনা তুলে ধরে মজহার বলেন, ‘গত ৩ জুলাই ভোরে আমি কম্পিউটারে লিখতে গিয়ে দেখি, চোখ খুলতে পারছি না, শুকনা। লেখা কিছুই পড়তে পারছি না। এ অবস্থা হলে ওষুধ কেনার জন্য ২৪ ঘণ্টা খোলা ফার্মেসিতে যাই। ওই সময় তিনজন লোক আমাকে ঘিরে একটি সাদা মাইক্রোবাসে জোর করে তুলে আমার চোখ বেঁধে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘ওই সময় মোবাইল ফোন আমার হাতেই ছিল। আমি আমার স্ত্রী ফরিদা আক্তারকে ডায়াল করা অবস্থায় ছিলাম। ভাগ্যক্রমে তাকে আমি প্রথম ফোন করতে পেরেছি। এরপর বাঁচার জন্য টেলিফোন করা, টাকা পাঠানোসহ অপহরণকারীরা যা কিছু করতে বলে, আমি তাই করি।’ মজহার বলেন, ‘তারা আমাকে যেখানে ছেড়ে দেয়, আমি চিনি না। আমি বুঝতে পারি, তারা আমার ওপর নজরদারি রেখেছে। তাদের নির্দেশ মতো সন্ধ্যায় হানিফ পরিবহনের গাড়িতে উঠলে গাড়িতে তারা আমাকে বাসের পেছনে বসিয়ে দেয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিশ্চুপ হয়ে ভীত, বিধ্বস্ত ও শারীরিক অসুস্থতায় নিস্তেজ হয়ে পড়ি। শোরগোল শুনে আমি জেগে উঠি। কিছু সাদা পোশাকের লোক জোর করে আমাকে নামিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। আমাকে আবার মারার জন্য নামিয়ে নিচ্ছে ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি।’ মজহার বলেন, ‘সাদা পোশাকের কিছু ব্যক্তি র্যাবের দিকে বন্দুক তুলে আমাকে শাসিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে উভয়ের মধ্যে প্রচণ্ড তর্ক হয়। কিন্তু র্যাব রীতিমতো ছোটখাটো যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে আমাকে তাদের গাড়িতে ওঠায়। আমার স্ত্রী ফরিদা আক্তারের সঙ্গে কথা বলে আমাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু সাদা পোশাকের লোকগুলো জোর করে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনার চেষ্টা করে।’ এ সময় প্রশ্ন করা হয়, সাদা পোশাকধারীরা র্যাবের চেয়েও শক্তিশালী কিনা, তাদের পরিচয় কী? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আপনারা অনেকেই বুদ্ধিমান সাংবাদিক। এটাকে আমরা কী বলি– স্কুপ; খুঁজে বের করেন, অভয়নগরে কী হয়েছিল। আপনারা সাংবাদিকরা যে প্রশ্ন করছেন এখানে আমার ছোট ভাইয়েরা, আমরাও তো সাংবাদিক ছিলাম। তাহলে আমি মনে সাংবাদিক হিসেবে এই স্কুপটুকু দেন, সেদিন মধ্যরাতে ওখানে কী হয়েছিল?’ কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহার বলেন, জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি। তিনি বলেন, অপহরণকারীরা তাঁকে খুলনা-যশোর সীমান্তের দিক দিয়ে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। তিনি আরো বলেন, ‘উদ্ধারের পর শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে আদাবর থানায় নিয়ে আসা হয়। প্রতিশ্রুতি দিয়েও আমাকে আমার পরিবারের কাছে যেতে দেওয়া হয়নি। অনেকক্ষণ থানায় বসিয়ে রেখে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।’ ফরহাদ মজহার আরও বলেন, অপহরণকারীরা তখনো এলাকায় থাকতে পারে ভেবে র্যাব তাঁকে খুলনায় নিয়ে চিকিৎসা-বিশ্রামের পাশাপাশি তদন্ত করতে চেয়েছিল। কিন্তু কে বা কারা র্যাবের গাড়ির দুই দিকের রাস্তায় ট্রাক থামিয়ে পথরোধ করে রেখেছিল। পরে র্যাবের গাড়িসহ তাঁকে এক জায়গায় নিয়ে বলা হয় সেটি অভয়নগর থানা। পুলিশের দুর্ব্যবহারের অভিযোগ করে ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘আমি ভিকটিম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে জোর করে র্যাবের গাড়ি থেকে নামানো হয়। আমার সঙ্গে প্রচণ্ড দুর্ব্যবহার করে। জিজ্ঞাসাবাদের নামে বলতে বাধ্য করা হয় যে, আমি বিনোদনের জন্য বেরিয়েছি। একটি গাড়িতে আমাকে নিয়ে উচ্চস্বরে গান গাইতে গাইতে পুলিশ ঢাকার দিকে রওনা হয়।’ ফরহাদ মজহার বলেন, ‘আমি জীবিত ফিরে আসায় আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করে মুখ বন্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। আমি সারা জীবন মানবাধিকার নিয়ে কাজ করেছি। বাংলাদেশে গুমের এ সংস্কৃতি বন্ধ করতে হলে, সকল মান-অপমান সহ্য করে হলেও বাংলাদেশে এ যাবৎ গুম হয়ে যাওয়া মানুষ যেন তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসতে পারে সে ক্ষেত্রে আমাদের সকলকে কাজ করতে হবে।’ জোরপূর্বক অপহরণের মতো মারাত্মক ও জঘন্য ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত না করে অভয় নগর থানার বয়ান অনুযায়ী পুলিশ ঘটনাকে অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন ফরহাদ। তিনি বলেন, ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে পুলিশের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা প্রেস কনফারেন্স করে আমাকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করার চেষ্টা করেন। পুলিশের প্রতিবেদন চ্যালেঞ্জ করলে আমার ও আমার পরিবারের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার হুমকি দেন। এতে পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।’ তিনি উল্লেখ করেন, গত ১৮ জুলাই ডিবি তাদের অফিসে ডেকে নেয়। সুষ্ঠু তদন্তের পরিবর্তে পুলিশের প্রতিবেদনে সায় না দিলে সামাজিকভাবে আরও লাঞ্ছিত করা ও মামলা করার হুমকি দেয়। এরপর থেকে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছেন। বিশিষ্ট এই কবি ও কলামিস্ট বলেন, ‘ডিবি অফিসে বিধ্বস্ত অবস্থায় আমাকে জেরা ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা আমাকে একটি লিখিত বক্তব্য ধরিয়ে দেয়। ওই বক্তব্যই পরবর্তীতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি হিসেবে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পাঠানো হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি নাটক করিনি। আমাকে যা বলা হয়েছে, তাই করেছি। আদালতে দেওয়া জবানবন্দি আমার না। আমাকে যা লিখে দেওয়া হয়েছে, আমি তাই আদালতে দিয়েছি।’ সাংবাদিকরা জানতে চান, ‘১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিতে হয় আদালতে। আপনি কোনও জবাববন্দি না দিয়ে ডিবি পুলিশের লিখে দেওয়া কাগজ দিয়েছেন?’ তার আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘উনি জবানবন্দি স্বেচ্ছায় দেননি। পুলিশ যেভাবে বলেছে, সেভাবে দিয়েছেন।’ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থায় এটি কিভাবে সম্ভব জানতে চাইলে এই আইনজীবী বলেন, ‘উনি জবানবন্দি লেখেননি। উনি বলেছেন, আদালতের সোফায় এলিয়ে পড়েছিলেন।’ সেই জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে মজহার বলেন, ‘এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি। তবে প্রয়োজন মনে করলে আমার আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ অপহরণের বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনাদের সাথে আজই শেষ না, আরও কথা হবে। আমি শুধু আমার একার জন্য বসিনি। দেশে যারা গুম হয়েছে, তাদের জন্যও আপনাদের সঙ্গে বসেছি।’ মজহার বলেন, ‘বিচারাধীন বিষয়ে আমাকে আর প্রশ্ন করবেন না। আমি চাই- বিচার স্বাধীন গতিতে চলুক। আমাকে গুম করা হয়েছিল। আমি একজন ভিকটিম। অথচ আমাকে মামলার আসামি করা হয়েছে।’ আদালতে দেওয়া জবানবন্দি ফরহাদ মজহারেরই: ডিবির যুগ্ম কমিশনার আদালতে ১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দি ফরহাদ মজহারের বলে দাবি করেছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন। তিনি বলেন, ‘ফরহাদ মজহার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে কোনও পুলিশ ছিল না। সেটা যদি পুলিশ লিখে দিতো, তাহলে সেখানে তিনি ম্যাজিস্টেটের কাছে বলেননি কেন?’ ডিএমপি’র গোয়েন্দা বিভাগের এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘ফরহাদ মজহারের সংবাদ সম্মেলন করার অধিকার আছে। তার কথা তিনি বলেছেন। ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি লিখে দেওয়া পুলিশের কাজ না। এটা ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন। ম্যাজিস্ট্রেট সেটা লিখে নিয়েছেন। সেখানে কোনও পুলিশ ছিল না।’ গত ৭ ডিসেম্বর অপরাধ বিষয়ক মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন ও মিথ্যা মামলা করে বিভ্রান্ত ও হয়রানির করার অভিযোগ আনায় ফরহাদ মজহার ও তার স্ত্রী মানবাধিকারকর্মী ফরিদা আক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করার আদেশ দেন আদালত। ওই দিনই মামলার বাদীর নারাজি দাখিলের জন্য সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে ঢাকা মহানগর হাকিম খুরশীদ আলম এ আদেশ দেন। উল্লেখ্য, গত ৩ জুলাই ভোররাতে শ্যামলীর রিং রোডের হক গার্ডেনের নিজ বাসা থেকে বের হন ফরহাদ মজহার। এরপর ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে তিনি তার স্ত্রীকে ফোন করে জানান, ‘ফরিদা, ওরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। ওরা আমাকে মেরে ফেলবে।’ পরে তার স্ত্রী আদাবর থানায় অভিযোগ করেন। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার রাতে র্যাব-৬ যশোর নওয়াপাড়া থেকে তাকে উদ্ধার করে। পরে তাকে আদাবর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এরপর তাকে মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ফরহাদ মজহার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তার স্ত্রীর করা যে জিডিটি মামলা আকারে নেওয়া হয় তার পরিপ্রেক্ষিতে ভিকটিম হিসেবে ফরহাদ মজহার আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। |