![]() কড়াইল বস্তির চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণে এখন যারা
সাইফ আহমেদ:
|
![]() বস্তির চাঁদাবাজিসহ নানা বাণিজ্য অব্যাহত রাখতে আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মী সরকার পতনের পর খোলস পাল্টে বিএনপিতে ভিড়েছেন। এসব নেতাকর্মী এবং বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী মিলে নতুন করে সিন্ডিকেট তৈরি করছেন বস্তিতে। তবে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা বিরাজ করছে সেখানে। এর জেরে সম্প্রতি হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দু’জনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। যে কোনো সময় সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জানা গেছে, অবৈধ অস্ত্র রয়েছে অনেকের কাছে। সম্প্রতি তুচ্ছ ঘটনায় বস্তিতে গুলি চালানোর ঘটনা ঘটেছে। মাত্র এক হাজার টাকার জন্য মো. এরশাদ নামে এক যুবক হোসেন আলী নামে একজনের পেটে গুলি করে। বস্তির বাসিন্দা মোবারক হোসেন জানান, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। বস্তিতে কথায় কথায় কিশোর গ্যাং-এর সদস্যরা কোপাকুপি করে। বস্তিবাসী জানান, আওয়ামী লীগ আমলের সিন্ডিকেটের হোতারা পালিয়েছেন। কিন্তু তাদের অনুসারী অনেকেই বস্তিতে রয়েছেন, যারা এখন নিজেদের বিএনপির নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। তারা এবং বিএনপি নেতাকর্মী মিলে নতুন করে বস্তিতে রাজত্ব শুরু করেছেন। রাতের নিরাপত্তা ও ময়লা অপসারণের নামে নেওয়া হচ্ছে চাঁদা। পালিয়ে যাওয়া নেতাদের ঘরবাড়িও দখল করে নেওয়া হয়েছে। এটি ‘কড়াইল বস্তি’ নামে পরিচিত হলেও এর ভেতরে বিভিন্ন নামে বস্তি রয়েছে। বস্তিটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ১৯ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন। তবে বেশির ভাগ অংশ পড়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। ৯৫ একর সরকারি জমিতে গড়ে ওঠা বস্তিতে ৬০ হাজারের মতো ঘর রয়েছে। সেখানে অন্তত ৪০ হাজার পরিবার বাস করে। জানা যায়, স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. খররুম ও মো. রাজা কড়াইলের বেলতলা, এরশাদনগর, আদর্শনগর, বেদে বস্তি ও ওয়ালভাঙা বস্তি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। পানি ও বিদ্যুৎ বিলের টাকা তুলছে খররুমের লোকজন। বেলতলা ইউনিট স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহসভাপতি কাজী রফিকুল ইসলামও এই সিন্ডিকেটের সদস্য। ৫ আগস্টের পর থেকে তিনি নিজেকে বিএনপি কর্মী বলে পরিচয় দেন। এই এলাকা ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির ত্রাণ ও পুনবার্সন সম্পাদক খান মো. সবুজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। শুরুতে সবুজ-খররুম এক গ্রুপে থাকলেও আধিপত্য নিয়ে কোন্দল শুরু হয়েছে তিন মাস আগে। এর জেরে গত ২২ জানুয়ারি বস্তিতে দু’পক্ষে সংঘর্ষ হয়। খররুমের ভাই মো. টিপু ও তার বন্ধু সোহেল রানাকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এ ঘটনায় বেলতলা বস্তির বাসিন্দা আহত সোহেল রানা বাদী হয়ে পরদিন বনানী থানায় মামলা করেন। এতে সবুজ, ইসরাফিল, মোমিন, পারভেজ, নাসির, রব মিয়া, বাবু, কালন, মণ্ডল হোসেন ও শাহজালালকে আসামি করা হয়। মামলার প্রতিবাদ ও পাল্টা মামলা নেওয়ার দাবিতে ২৬ জানুয়ারি রাতে আসামিপক্ষের অন্তত ৫০ জন বনানী থানার সামনে বিক্ষোভ করে। সর্বশেষ কয়েকদিন আগে মামুন নামে এক যুবককে কুপিয়ে জখম করে সন্ত্রাসীরা। মামলার বাদী সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা বেলতলা-টিঅ্যান্ডটি ব্রিজপাড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ সময় সবুজ ও তার লোকজন খররুমকে খুঁজছিল। তাকে না পেয়ে খররুমের ভাই টিপু ও আমার ওপর হামলা চালায়।’ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বস্তির অটোরিকশার টোকেন বাণিজ্য করতেন বনানী থানা শ্রমিক লীগ নেতা ইসরাফিল। এক সময়ের বস্তির নিয়ন্ত্রক জুনায়েদের (পলাতক) কাছের লোক ছিলেন তিনি। ইসরাফিল বর্তমানে নিজেকে বিএনপি নেতা হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। এ ছাড়া দখল ও বাণিজ্য সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য মোমিন, সাগর, নাসির ও বাবু মহাখালীর যুবলীগ নেতা সুন্দরী সোহেলের অনুসারী কর্মী ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তারা বস্তিতে নিজেদের বিএনপি নেতা বলে পরিচয় দেন। গোডাউন বস্তির চাঁদাবাজির দখল নিয়েছেন যুবলীগ নেতা ও র্যাবের সোর্স শহীদ। তিনি এখন পরিচয় বদলে বিএনপি নেতা বনে গেছেন। সম্প্রতি শহীদ বাহিনী বস্তিতে অবৈধভাবে মেলা বসিয়েছে। যেখান থেকে প্রতিদিন আদায় হয় ২০ হাজার টাকা। মেলায় জুয়া খেলাও চলে। ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পদাক খান মো. সবুজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কিছু লোক বিএনপিতে অনুপ্রবেশ করেছে। তাদের সঙ্গে নিয়ে খররুম বস্তিতে চাঁদাবাজি ও দখলবাজি করছে।’ বেলতলা, এরশাদনগর, আদর্শনগর, বেদে বস্তি ও ওয়ালভাঙা বস্তি ৫ আগস্টের আগে নিয়ন্ত্রণ করতেন স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জুনায়েদ, নায়েব আলী, সোহাগ ও রাজু। জুনায়েদের বাড়ি দখল করেছেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির কৃষিবিষয়ক সম্পাদক মণ্ডল হোসেন; নায়েব আলীর বাড়ি দখল করেছেন মো. কালন, রুবেল, কাঞ্চন ও মিলন। শ্রমিক লীগ নেতা সোহাগের বাড়ি দখল করেছেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজা মিয়া। রাজা মিয়া বলেন, 'বাড়ি কারও দখলে না। জুনায়েদ, নায়েব আলী, সোহাগসহ তাদের সিন্ডিকেট বস্তির এক কোটি ৯ লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া রেখে পালিয়েছে। এখন ওদের বাড়ির ভাড়া তুলে বকেয়া পরিশোধ করা হচ্ছে।' তার এমন জবাবে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, বিদ্যুৎ এর বকেয়া বিল উত্তোলনের দায়িত্ব আসলে কার? মণ্ডল হোসেন বলেন, ‘২০০১ সাল থেকে বিএনপির রাজনীতি করি। ২০১৮ সাল থেকে রাজনৈতিক কারণে বস্তিতে থাকতে পারতাম না। ৫ আগস্টের পর থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে জুনায়েদের বাড়িতে আছি। জুনায়েদ আমার পরিচিত। তার বাড়ি দখল করব কেন? জুনায়েদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সে বাসা ছেড়ে দেবে।’ বেলতলা বস্তিতে প্রবেশ করার আগে বাঁ পাশে ‘আদর্শ মার্কেট’ নামে একটি বাজার বসিয়েও চাঁদাবাজি করতেন জুনায়েদ-নায়েব আলীরা। এই মার্কেটও এখন খররুমদের দখলে। সেখানে মুদি দোকান, কাঁচাবাজার, মুরগিসহ নানা সামগ্রীর অন্তত ৪০টি দোকান আছে। এসব দোকান থেকে ভাড়া তুলছেন তারা। জানা যায়, মোশারফ বাজার বস্তিতে অন্তত ৭ হাজার পরিবার বাস করে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতেন আওয়ামী লীগের মোস্তফা, শহীদুল, জিয়ারুল, তাসলিমা, মন্জুল হক। ৫ আগস্টের পর তারা পালিয়েছেন। বতর্মানে মোশারফ বাজার বস্তি ইউনিট বিএনপির সভাপতি আকমল হোসেন, সহসভাপতি মোমিনুল ইসলাম, আল আমিন নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন। মোমিনুল বলেন, ‘১৬ বছর দৌড়ের ওপর ছিলাম। এলাকায় থাকতে পারিনি। পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এলাকায় এসেছি। নিয়ন্ত্রণ বলতে কিছু না; আমরা এলাকায় থাকি।’ আওয়ামী লীগের আব্দুস সোবহান মাওলানা, পানি শহীদ, সেলিম ঢালী কামালের দখলে ছিল বউবাজার। এখন দখলে নিয়েছেন বিএনপির মো. মামুন. মো. ইমরান, আলমগীরসহ কয়েকজন। জামাই বাজারের দখলদার ছিলেন হাসান, এনামুল, মো. আলী, নুরু, জুয়েল। তারা সবাই পালিয়েছেন। এখন নিয়ন্ত্রক নজরুল, রোকেয়া, জসিম, জানু খাতুন, আমেনা ও বলাকা। তারা বিএনপি নেতাকর্মী হিসেবে পরিচয় দেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বস্তিতে বিদ্যুতের বৈধ প্রিপেইড মিটার প্রায় একশ। এগুলো বাড়িওয়ালারা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া বৈধভাবে অন্তত ৭০টি মিটার রয়েছে, যেগুলো দিয়ে ব্যবসা করা হয়। এসব মিটার থেকে বিভিন্ন ঘরে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হচ্ছে। এ ছাড়া চোরাই সংযোগও দেওয়া হয়। প্রতিটি বাল্ব ও ফ্যানের জন্য মাসে তিনশ টাকা করে আদায় করা হয়। টেলিভিশনের জন্য তিনশ এবং ফ্রিজ ব্যবহার করলে ৬০০ টাকা গুনতে হয় বাসিন্দাকে। পানি তোলার মোটর চালাতে মাসে দিতে হয় ৩ হাজার টাকা। অন্তত ৭০ হাজার কক্ষের এই বস্তিতে পানির বৈধ মিটার আছে প্রায় ১ হাজার ৭০০টি। অধিকাংশ বাসিন্দা বৈধ মিটারের বাইরে। বিভিন্ন সিন্ডিকেট চোরাই পানির সংযোগ দিয়ে বাসিন্দাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে। বৈধ পানির পাইপ ছিদ্র করেও চোরাই পথে পানি নেওয়া হয়। মিনিট ও ঘণ্টা হিসেবে পানি বিক্রি করা হয়। প্রতিদিন ৩০ মিনিট পানি নিলে মাসে বিল দিতে হয় দেড় হাজার টাকা। দিনে এক ঘণ্টা পানি নিলে মাসে গুনতে হয় আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা। |