![]() আশঙ্কার চেয়ে কম এবার এপ্রিলের তাপপ্রবাহ, বৃষ্টি বেড়েছে চারগুণ
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
![]() বাংলাদেশে গ্রীষ্মের শুরু এপ্রিলে। ফলে এ মাসটিকে বছরের উষ্ণতম সময় গণনার মাস হিসেবেও ধরা হয়। প্রকৃতি আর ঋতুর পালাবদলে ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চের তুলনায় এপ্রিলে স্বাভাবিকভাবেই গরমের তীব্রতা বাড়ে। এসময়ে সূর্যের তেজ যেমন বাড়ে, বৃষ্টিপাতও হয় কম। প্রতিদিনই একটু একটু করে বাড়ে দিন ও রাতের তাপমাত্রা। তবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এবছরের এপ্রিল গরমের দিক থেকে ছিল অনেকটাই নরম। গত বছর (২০২৪ সালে) এপ্রিলের প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে তাপপ্রবাহ ছিল। এপ্রিল ও মে মাস মিলিয়ে তাপপ্রবাহ ছিল টানা ৩৫ দিন। যার স্থায়িত্ব ছিল বিগত ৭৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ। এবছর এপ্রিলে তাপপ্রবাহ গত বছরের মতো এতটা দীর্ঘ হয়নি। তবে মাসের একেবারে শেষ দিকে এসে তাপপ্রবাহ বেড়েছে। টানা ছয়দিনের তাপপ্রবাহে মানুষের হাহুতাশও দেখা গেছে। ২০২৪ সালের এপ্রিলে বৃষ্টি বা কালবৈশাখী ঝড় না হওয়াকে গরম না কমা বা টানা তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন আবহাওয়াবিদেরা। আবহাওয়া অফিসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের এপ্রিলে মাত্র একটি বড় কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। পুরো মাসজুড়ে বৃষ্টিপাত হয়েছে মাত্র ১২৭৮ মিলিমিটার। ফলে মাসের ৮ দিনই তাপমাত্রা ছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে। যা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ হিসেবে বিবেচিত। মাসটিতে ১২ দিন ছিল তীব্র তাপপ্রবাহ, তখন তাপমাত্রা ছিল ৪০ থেকে ৪২ ডিগ্রির ঘরে। মাসের বাকি দিনগুলোত ছিল মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ। একই মাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রার পারদ উঠেছিল যশোরে ৪৩ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত। অন্যদিকে, চলতি বছর এপ্রিলের ৩ ও ৪ তারিখ ছাড়া দেশের কোথাও না কোথাও প্রতিদিনই বৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। ১ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত এই ২৭ দিনে সারাদেশে ৪ হাজার ৮২৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। মাসটিতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে গত ২৩ এপ্রিল যশোরে ৩৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে ১৮ দিন। তবে এর মধ্যে তীব্র কিংবা অতি তীব্র তাপপ্রবাহ ছিল না। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা খুব বেশি নেই। এপ্রিলের শেষে শুরু হওয়া বৃষ্টি মে’র প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। পরবর্তী দিনগুলোতে তাপপ্রবাহ বয়ে গেলেও গত বছরের একই সময়ের মতো তা তীব্র অথবা তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এপ্রিলে যে কারণে তাপপ্রবাহ কম আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, প্রচণ্ড গরম অনুভূত হলে তা স্থানীয়ভাবে সৃষ্ট মেঘের মাধ্যমে বৃষ্টি হলে কমে না। তাপপ্রবাহ বা প্রচণ্ড গরমের সময় বড় ধরনের বজ্রঝড় হলে সেটি তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়। তাপপ্রবাহের গরম বজ্রঝড়েই কমা সম্ভব। এ বছর মৃদু তাপপ্রবাহের মাঝেই বজ্রঝড় হয়েছে। ফলে মাঝারি তাপপ্রবাহ তীব্র হয়নি এবং মৃদু তাপপ্রবাহও বেশি দিন দীর্ঘায়িত হয়নি। আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা বলেন, এ বছর মার্চ ও এপ্রিল মাসে নিয়মিত কালবৈশাখী ঝড় এবং বজ্রবৃষ্টি হয়েছে, যা বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ কমিয়ে দিয়েছে। ঝড়বৃষ্টির কারণে মেঘলা আকাশে সরাসরি সূর্যের তাপ পড়ছে না, ফলে গরম কম অনুভূত হচ্ছে। একাধিক কালবৈশাখী ও বজ্রসহ বৃষ্টি আবহাওয়া অফিসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এপ্রিলে পাঁচ থেকে সাতটি কালবৈশাখী ঝড়ের পূর্বাভাস থাকলেও মাসটিতে কালবৈশাখী ঝড় ও বজ্রবৃষ্টি আরও বেশি হয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, প্রায় ১০-১২ দিন সারাদেশে কালবৈশাখী ঝড় হয়েছে। এছাড়াও বিক্ষিপ্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। মাসটিতে প্রথম কালবৈশাখী ঝড় হয় ৬ এপ্রিল। এরপর ১০ এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন বজ্রঝড়সহ বৃষ্টি ছিল। ১৬ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে বৃষ্টি ছিল। প্রভাব রয়েছে লা নিনার কোনো একটি বছরের তাপমাত্রা কম বা বেশি হওয়ার পেছনে প্রশান্ত মহাসাগরের এল নিনো ও লা নিনার প্রভাব বড় ভূমিকা রাখে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, এপ্রিলে এল নিনোর প্রভাব ছিল দুর্বল। অন্যদিকে লা নিনা নিউট্রাল বা মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে। আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানার ভাষ্য, লা নিনা বা এল নিনো কোনোটাই শক্তিশালীভাবে সক্রিয় নয়। নিউট্রাল অবস্থায় লা নিনার ঠান্ডা প্রভাবটা আংশিক থাকে, ফলে গরমের প্রভাব পুরোপুরি তীব্র হয় না। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প এ বছর এপ্রিলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্প। বঙ্গোপসাগর থেকে যত বেশি জলীয়বাষ্প আসে, তত বেশি মেঘ জমে এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বাড়ে। ‘এপ্রিলে বঙ্গোপসাগর থেকে অধিক পরিমাণ জলীয়বাষ্প (ময়েশ্চার) বাতাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে এসেছে। এই জলীয়বাষ্প যখন ঠান্ডা হয়, তখন তা মেঘ তৈরি করে। সেই মেঘ যখন ভারী হয়ে যায়, তখন বৃষ্টি নামে’- বলেন আফরোজা সুলতানা। বায়ুদূষণ ও মেঘের ঘনত্ব স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপসের চেয়ারম্যান ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, অনেকসময় বায়ুদূষণের কারণে আকাশে ধোঁয়াশা তৈরি হয়, যেটা সূর্যের আলোকে আটকে দেয়। তবে সেটা যদি মেঘের সঙ্গে মিশে যায়, তখন এটি গরম কম অনুভূত হওয়ায় ভূমিকা রাখে। এ বছর গরমেও বায়ুদূষণ বেশি। আর সেটা হচ্ছে আকাশে জমে থাকা মেঘের কারণে। ‘তবে অনেকসময় মে মাসেও প্রচণ্ড গরম অনুভূত হয়, পরবর্তী সময়ে বর্ষা শুরু হওয়ায় তাপমাত্রা কিছুটা কমে আসে’- বলেন এ পরিবেশ বিজ্ঞানী। এ বছর মে মাসে তাপমাত্রা বা গরম কেমন থাকবে, বৃষ্টিপাত কতটুকু হতে পারে, জানতে চাইলে আবহাওয়াবিদ শাহনাজ সুলতানা বলেন, এখন পর্যন্ত আমরা যা দেখছি তাতে মে মাসেও তীব্র তাপপ্রবাহের সম্ভাবনা কম। বিচ্ছিন্নভাবে তাপপ্রবাহ হতে পারে। মৌসুমের স্বাভাবিক গরম থাকতে পারে। এছাড়া স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। জানতে চাইলে পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত ‘আরেকটি বিষয় হলো, পশ্চিম দিক বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে বাতাসটা আসে সেটা সাধারণত পাকিস্তান ও ভারতের পশ্চিমাঞ্চল (রাজস্থান, গুজরাট) থেকে আসে। যখন এই গরম বাতাস পশ্চিম দিক থেকে বাংলাদেশের দিকে আসে (এপ্রিল-মে মাসে), তখন এখানে আর্দ্রতার সঙ্গে মিশে এক ধরনের ‘হিট ডোম’ তৈরি করে। এতে তাপমাত্রা বেড়ে যায়।’বলেন, আমি মনে করি এ বছর এখন পর্যন্ত গরম স্বাভাবিক আছে। গত বছর এপ্রিলে যা অস্বাভাবিক ছিল। বাংলাদেশে গরম কিন্তু মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত থাকে। সে হিসাবে মে-জুন এখনো বাকি। ‘এখন দক্ষিণ দিক থেকে বাতাস কিছুটা বেশি আসছে। এই বাতাস ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশে আসছে। এই বাতাসের সঙ্গে গরম কম থাকছে। এই দুই স্থানের বাতাসের তারতম্য তাপমাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে’- যোগ করেন এ জলবায়ু বিশেষজ্ঞ। |