 / স্বাস্থ্য / রেডিওথেরাপির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা চরম ভোগান্তি
রেডিওথেরাপির জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা চরম ভোগান্তি
নতুন বার্তা, ঢাকা:
Published : Saturday, 30 December, 2023 at 12:25 AM
|
 ক্যান্সার আক্রান্ত শিল্পী বেগম। বয়স ৩২। এক বছরের বেশি সময় ধরে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত। যশোর থেকে ঢাকায় এসে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ৪টি ক্যামোথেরাপি দিয়েছেন। রাজধানীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্য তিনবার তারিখ দিয়েছে তাকে। তবে একবারও থেরাপি নিতে পারেননি শিল্পী। দীর্ঘ ৬ মাস ঘুরে অবশেষে গত রোববার রেডিওথেরাপি নেন। তার স্বামী ইমদাদুল জানিয়েছেন, রেডিওথেরাপির জন্য অনেক ঘুরতে হয়েছে। প্রথম দুই মাস পর রেডিওথেরাপি দেয়ার তারিখ দিলে স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন তিনি।তবে সেদিন তাকে আবার নতুন তারিখ দেয়া হয়। এভাবেই তিনবার পরিবর্তন করা হয় তারিখ। ফখরুল মাদ্রাসার পিয়নের চাকরি করেন। রেডিও থেরাপির জন্য ক্যান্সার হাসপাতালে শুরুতে তাকে দেড় মাসের পর একটা তারিখ দেয়া হয়। অবশ্য সেই তারিখ অনুযায়ী রেডিওথেরাপি নিতে পারেননি। ফখরুল জানান, এক রোগী হাসপাতালের স্টাফদের ১০ হাজার টাকা দেয়াতে সিরিয়ালের ব্যবস্থা করে দেয়। পরে তিনিও ওই স্টাফকে ৮ হাজার টাকা দেন। ফখরুল বলেন, টাকা দেয়ার পর আমাকেও ওই স্টাফ দ্রুত ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন প্রতিদিন এসে থেরাপি নিচ্ছি। আর মাত্র দু’দিন দিলে শেষ হবে। ক্যান্সার হাসপাতাল সূত্র বলছে, রেডিওথেরাপির জন্য রোগীদের মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭ মাসের অধিক সময়ও লেগে যায় রেডিওথেরাপির সিরিয়াল আসতে। কখনও কখনও থেরাপি দেয়ার আগে রোগীর মৃত্যুও হয়। হাসপাতালটিতে রেডিও থেরাপির মেশিন রয়েছে ৬টি। তবে এর ৪টিই দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট হয়ে পড়ে আছে। বাকি দু’টি মেশিন দিয়ে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা। এসব মেশিন দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২০০ এর মতো রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয়। যা চাহিদার চেয়ে একেবারে নগণ্য। রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে দৈনিক অন্তত ৭০০ থেকে ৮০০ রোগীর চাহিদা রয়েছে। ক্যান্সার হাসপাতালে ২টি রেডিওথেরাপির মেশিন আসার কথা রয়েছে; তা আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে পাওয়া যেতে পারে বলে জানিয়েছেন ক্যান্সার হাসপাতালের সহকারী পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. নাজির উদ্দিন মোল্লাহ। সূত্র আরও জানায়, রেডিওথেরাপি দেয়ার আগেও পদে পদে ভুগতে হয় রোগীদের। হাসপাতালে কোনো রোগী প্রবেশ করার পরই শুরু হয় ভোগান্তি। স্ট্রেচার, হুইল চেয়ারের অভাব প্রকট হাসপাতালটিতে। এর সুযোগ নেয় বহিরাগতরা। হাসপাতালের ভেতরে ঘণ্টা ভিত্তিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকায় এসব ভাড়া দেয়া হয়। এ ছাড়া অনেক রোগীকে বাহিরে থেকে কিনেও ব্যবহার করতে হয় হুইল চেয়ার। ডাক্তার দেখানোর পর বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেয়া হয় রোগীকে। এসব পরীক্ষা করানোর জন্য রোগীদের ভাগিয়ে নিতে আশেপাশের ক্লিনিকের এজেন্টরা ওঁত পেতে থাকেন। অভিযোগ রয়েছে, এতে স্টাফরা যাতে বাগড়া দিতে না পারে এজন্য তাদেরও কমিশন দেয়া হয়। রোগী পর্যাপ্ত পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে আসলে দেখানো হয় ডাক্তারকে। রোগীদের এসব রিপোর্ট নিয়ে প্রতিদিন মেডিকেল বোর্ড বসানো হয়। তখন গুরুতর অবস্থা বুঝে রোগীদের ভর্তি নেয়া হয়। তবে স্টাফরা টাকা নিয়ে রোগীদের ভর্তি, সিট পাওয়ানোর আশ্বাস দেয়। যেসব রোগীরা সিট না পায় তাদের হাসপাতালের আশেপাশে ঘরভাড়া নিয়ে থাকতে হয়। এই ঘরভাড়া দেয়ার সঙ্গেও জড়িত থাকে হাসপাতালের কর্মচারীরা। তবে এসব বিষয়ে হাসপাতালে গিয়ে কথা বলতে চাইলেও সাক্ষাৎ দেননি হাসপাতালটির পরিচালক অধ্যাপক মো. নিজামুল হক। মুঠোফোনে কল করা হলেও তিনি কোনো কথা বলেননি। রেডিওথেরাপির জন্য রেজিস্ট্রেশন কার্ড পেতে হয় রোগীকে। হাসপাতালের ১৫৩ ও ১৫৪ নম্বর কক্ষ থেকে এই কার্ড দেয়া হয়। এই কার্ড পেতে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয় রোগীদের। কার্ড পেলেও রেডিওথেরাপির সিরিয়াল পেতে লেগে যায় মাসের পর মাস। শুরুতে কার্ড পাওয়ার ২ থেকে ৩ মাস পর রেডিওথেরাপির একটা তারিখ দেয়া হয়। কিন্তু সেই তারিখে চিকিৎসা নিতে পারেন না রোগীরা। সেদিন দেয়া হয় আরেকটি তারিখ। এভাবে দফায় দফায় তারিখ পরিবর্তনের পর মেলে কাক্সিক্ষত সিরিয়াল। ততদিনে অবশ্য ৬ থেকে ৭ মাস লেগে যায়। অভিযোগ রয়েছে, ৮ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে দ্রুত পাওয়া যায় এই সিরিয়াল। স্টাফ ও নার্সদের একটি চক্র এর সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া হাসপাতালের সামনে এম্বুলেন্স ভাড়া নিতেও থাকে সিন্ডিকেট। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। তবে হাসপাতালটিতেও রয়েছে একটি মাত্র মেশিন। হাসপাতাল সূত্র বলছে, প্রতিদিন সকাল সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ৭০ জন রোগীকে থেরাপি দেয়া হয়। তবে রোগীদের চাহিদা রয়েছে ৪ থেকে ৫ গুণেরও বেশি। হাসপাতালটিতে সপ্তাহে মাত্র ৪ থেকে ৫ জন নতুন রোগীকে রেডিও থেরাপি দেয়া হয়। ক্ষেত্র বিশেষে রোগীদের চিকিৎসার জন্য সিরিয়াল পেতে ৭ মাসের বেশি সময়ও অপেক্ষা করতে হয়। এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে ২৫০ থেকে ৩০০ রোগীর অগ্রিম সিরিয়াল রয়েছে। তাদের রেডিওথেরাপী শেষ হতেই কমপক্ষে আগামী বছর মার্চ-এপ্রিল মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এরমধ্যে নতুন রোগীদের সিরিয়াল হবে তারও পরে। ঢাকার ধামরাই উপজেলায় থাকেন শাহানাজ। বিএসএমএমইউতে রেডিওথেরাপি দিচ্ছেন তিনি। তবে এরজন্য ৫ মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে তাকে। স্বামী নাজিম বলেন, প্রথম আমাকে বলেছিল দুই থেকে তিন মাস পরে পাওয়া যাবে। দুই মাস যাওয়ার পর থেকে আমি খোঁজ নেয়া শুরু করি। হাসপাতালে ৫বার এসেছি। কিন্তু সিরিয়াল পাই নাই। শাহানাজ গত মঙ্গলবার সিরিয়াল পেয়ে প্রথম রেডিওথেরাপি দিয়েছেন বলেও জানান তার স্বামী নাজিম। দেশের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল ঢাকা মেডিকেল কলেজেও দুইটি রেডিও থেরাপির মেশিন রয়েছে। এর একটি দীর্ঘদিন ধরেই অকেজো পড়ে রয়েছে। বাকি একটি দিয়ে প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ জন রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হয় যদিও রোগীর চাহিদা এর ১০ গুণেরও বেশি। তবে গত বুধবার সেটিও নষ্ট হয়ে যায় বলেও জানান হাসপাতালের রেডিওথেরাপির টেকনিশিয়ানরা। এতে আপতত বন্ধ রয়েছে চিকিৎসা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেডিওথেরাপি দিতে বিলম্ব হওয়ার কারণে তা রোগীর ওপর পুরোপুরি কার্যক্রর হচ্ছে না। একটা চিকিৎসার কার্যকারিতার নিদির্ষ্ট মেয়াদ থাকে। রেডিওথেরাপি দেয়ার জন্যও তেমন নির্দিষ্ট সময় থাকে। দুই মাসের জায়গায় যদি ৬ থেকে ৭ মাস পরে দেয়া হয় তাহলে তার কার্যকারিতা না হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ স্তন ক্যান্সার সচেতনতা ফোরামের প্রধান সমন্বয়কারী অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন বলেন, দরিদ্র মানুষের সরকারি হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে হয়। কিন্তু সেখানে রেডিওথেরাপির ভয়াবহ অবস্থা। আগে এক-দেড় মাস স্বাভাবিক সময়েই অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু এখন অধিকাংশ মেশিন নষ্ট হওয়ায় ৬ থেকে ৭ মাস বা এক বছর পরেও অনেককে তারিখ দেয়া হয়। দেখা যাবে তারা তখনো চিকিৎসা পান না। এত লম্বা সময় চিকিৎসা না পেলে সেই চিকিৎসা আর কোনো কাজেও আসে না। অনেকে তার আগেই চিকিৎসার বাইরে চলে যায়। এই পরিস্থিতি অত্যন্ত বিপজ্জনক ও হতাশাজনক। তিনি বলেন, যেখানে বিভিন্ন সেক্টরে হাজার হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে সেখানে মাত্র ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা দামের মেশিন একসঙ্গে ৬টা কিনলেও কোনো সমস্যা হতো না। এটা সম্ভব ছিল। যারা এসবের দায়িত্বে আছে তাদের কারণেই এটা হচ্ছে না। এরজন্য কোনো জবাবদিহিতাও নাই। হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে রেডিওথেরাপির চিকিৎসা নিতে হয় এতে রোগীদের কী ধরনের সমস্যা হয় জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, এটা মারাত্মক সমস্যা। এতে অনেক রোগী মৃত্যু পথযাত্রী হয়। কেউ কেউ মৃত্যুর পরে রেডিওথেরাপির তারিখ পায়। এটার জন্য রেডিওথেরাপির মেশিন আরও এনে প্রশিক্ষণ দিয়ে রোগীদের সেবা দেয়া উচিত। আমি ৬ মাস আগে একটা মেশিন চেয়েছি। এখনো পাইনি। পেলে এখানে আরও ভালো সেবা দিতে পারবো। অনেক মেশিন নষ্ট, এজন্য আমাদের এখানে অনেক চাপ পড়ে। ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের দুর্ভোগের কথা স্বীকার করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, সরকারি হাসপাতালের মেশিনের ওপর অনেক চাপ পড়ে। অনেক রোগীদের সেবা দিতে হয়। তাছাড়া সরকারি হাসপাতালে মেইনটেনেন্সও ভালো হয় না। ক্যান্সার হাসপাতালের নতুন দু’টো মেশিন কেনার কথা রয়েছে। এই মেশিন রেডিমেট তৈরি থাকে না। অর্ডার দেয়ার পর বানিয়ে তা দেশে আনা হয়। ক্যান্সার হাসপাতালে যে দু’টো মেশিন কেনার কথা তা প্রক্রিয়াধীন আছে। আশা করি আগামী বছর ফেব্রুয়ারি-মার্চের দিকে তারা মেশিন দুইটা পেয়ে যাবেন। তিনি বলেন, যাদের থেকে আমরা মেশিন কিনেছি তাদের সঙ্গে আমাদের ওয়ারেন্টি চুক্তি শেষ। এখন তারা ঠিক করার জন্য যে দাম চাচ্ছে তা আমাদের ধারণার অনেক বাইরে। তাই আমাদের যারা বিশেষজ্ঞ রয়েছে তাদের নিয়ে একটা টিম করেছি। তারা দেখে জানাবে এটা আদৌও ঠিক করা যাবে কিনা এবং তা দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যাবে কিনা। যদি ঠিক করার কিছুদিন পর আবার নষ্ট হয়ে যায় তাহলে আমাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। সরকারের অর্থও নষ্ট হবে। |
