/ সারাদেশ / পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে এক জেলার ৪ শতাধিক হাসপাতাল
পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে এক জেলার ৪ শতাধিক হাসপাতাল
নতুন বার্তা, নোয়াখালী:
|
নোয়াখালীতে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে সাড়ে চার শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এসব প্রতিষ্ঠান পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা ভুলে বসে আছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র নিয়ে আর নবায়ন করেনি। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি। অথচ পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র নেওয়া সব প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেই কোনও মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। যেখানে-সেখানে তাদের ফেলা বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেডিক্যাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিবেশসম্মতভাবে না হলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে প্রতি বছর লাইসেন্স নবায়ন করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। পরিবেশ অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ের তথ্যমতে, নোয়াখালীতে পাঁচ শতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি হাসপাতাল ও ১৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশ ছাড়পত্র আছে। এ ছাড়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা ও দুটির আবেদন অনুমোদন করে ছাড়পত্রের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। এর বাইরে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। তবে ৩৬টি হাসপাতাল ও ৩৮টি ডায়গনস্টিক সেন্টার গত বছরের বিভিন্ন সময়ে ছাড়পত্রের আবেদন করলেও নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না করায়, তা বাতিল করে দেয় পরিবেশ অধিদফতর। পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন-২০১০ অনুযায়ী যেকোনো ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিবন্ধিত হওয়ার আগেই পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে জেলায় ১০২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স নবায়ন করেছে। এর মধ্যে পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র থাকা ৩১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে এর বাইরে বাকি ৭১টি প্রতিষ্ঠান পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া কীভাবে লাইসেন্স নবায়ন করেছে, সে ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে পারেননি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, চিকিৎসাকাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামের ক্ষতির মাত্রাভেদে সেগুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করে ছয় রঙয়ের পাত্রে রাখার নিয়ম। যেসব সরঞ্জাম পুনরায় ব্যবহার করা যায়, সেগুলোকে অটোক্লেভ যন্ত্রের মাধ্যমে সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা বাধ্যতামূলক। প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে তা মানা হচ্ছে না। ফলে রোগীর ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও সাধারণ বর্জ্য একসঙ্গে ফেলা হচ্ছে। এতে চিকিৎসক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অন্যান্য রোগী এমনকি রোগীর স্বজনরাও নানা রোগে আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছেন। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এবং মা ও শিশু হসপিটালের চেয়ারম্যান অসীম রায় নয়ন বলেন, ‘আমাদের সমিতির অধীনে প্রায় ৫০টি মতো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সাত-আটটির পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। বাকিগুলো ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। আমরা, সরকারের সব নিয়ম এবং শর্ত মেনে ব্যবসা পরিচালনা করতে চাই। কিন্তু আমরা আবেদন করার পর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র মেলে না। এই প্রক্রিয়া আমাদের জন্য আরও সহজ করা প্রয়োজন।’ এদিকে, পৌর এলাকার সব সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব পায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’। পৌরসভার পক্ষ থেকে চুক্তি সাপেক্ষে তারা কার্যাদেশ পায়। মাসিক চুক্তিতে পৌর এলাকার হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ করে এই প্রতিষ্ঠান। অবশ্য তাদেরও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া তারা পৌরসভার কার্যাদেশ কীভাবে পেয়েছে, তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ ছাড়া তারা বর্জ্যসমূহ অপসারণ করে পৌরসভার ডাম্পিং সাইটে বিধিবহির্ভূতভাবে অপসারণ করছে। শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে বর্জ্য একই ড্রামে অথবা একই গাড়িতে করে পরিবহন করে একই স্থানে রাখা হচ্ছে। এতে পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী ও চলাচলরতরা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন। এ ব্যাপারে শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পরিচালক মো. আবুল বাশার বলেন, ‘পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আমরা পরিবেশ অধিদফতরে আবেদন করেছি। জেলা স্বাস্থ্য কমিটির মিটিংয়ে জেলা প্রশাসক আমাদের এ ব্যাপারে তাগিদ দেন। আর হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা সব বর্জ্য পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনে ফেলার যে অভিযোগ উঠেছে, সে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখবো।’ নোয়াখালী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, ‘পৌরসভার পক্ষ থেকে শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে পৌর এলাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বর্জ্য অপসারণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কার্যাদেশ দেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, হাসপাতাল ও ক্লিনিক থেকে বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে তা নিয়ে যাবে বাংলাবাজারে। সেখানে বর্জ্য পোড়ানোর চুল্লি (ইনসিনেটর) আছে বলে আমাদের জানিয়েছে। তারা সাধারণ ময়লাগুলো পৌরসভার ডাম্পিং সাইটে দিয়ে দেবে এবং বিষাক্ত বর্জ্যগুলো ইনসিনেটরে নিয়ে যাবে ও পুড়িয়ে শেষ করবে। এ নিয়ে চুক্তি হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, হাসপাতালের সব বর্জ্য যদি তারা আমাদের ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যায়, তাহলে চুক্তি বাতিল করে দেওয়া হবে। ডাম্পিং স্টেশনে হাসপাতালের বর্জ্য ফেলতে তাদের বারবার নিষেধ করা হয়েছে। গত মাসে একবার গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে। তাদের পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকার বিষয়টি আমরা জানি। এটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে, কিন্তু দেওয়া হয়নি।’ পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকা একটি প্রতিষ্ঠান কীভাবে বর্জ্য অপসারণের কার্যাদেশ পেয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, ‘তারা বলেছিল ছাড়পত্র নেবে। এখন যদি তা নিতে না পারে, তাহলে আমরা অন্য পার্টিকে কাজ দেবো। পরিবেশ ছাড়পত্র তো আমাদেরও (পৌরসভার) নেই। এখন কাউকে না কাউকে দিয়ে তো কাজ করাতে হবে। নোয়াখালীতে যেসব প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র আছে, তাদের একজনেরও কিন্তু ইনসিনেটর নেই। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে তারা কীভাবে পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে।’ এসব বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতর নোয়াখালী কার্যালয়ের উপপরিচালক মিহির লাল সরদার বলেন, ‘নোয়াখালী জেলায় ১৩টি হাসপাতাল ও ১৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ ৩১টি প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। এ ছাড়া পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা ও দুটির ছাড়পত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর বাইরে সাড়ে চার শতাধিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।’ শর্ত পূরণ না করায় গত বছরের বিভিন্ন সময়ে ৭৪টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের করা আবেদন বাতিল করা হয়েছে উল্লেখ করে মিহির লাল সরদার বলেন, ‘আমাদের কাছে কোনও আবেদন জমা পড়লে তদন্ত সাপেক্ষে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সেটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিই। যেসব প্রতিষ্ঠানের আবেদন বাতিল করা হয়েছে, তাদেরও চিঠির মাধ্যমে বিষয়টি জানানো হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা কেবল আবেদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আবেদন পরবর্তী তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে পরিবেশ অধিদফতরের দেওয়া শর্তসমূহ পূর্ণ করার জন্য তাদের চিঠি দিয়ে থাকি। সব শর্ত পূরণ হলেই ছাড়পত্র দেওয়া হয়।’ পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়া কীভাবে প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করা হচ্ছে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, ‘পরিবেশ অধিদফতরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনও প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ নেই। তারপরও যদি এখানে কোনও অসঙ্গতি থেকে থাকে, সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে দেখবো।’ |