/ অর্থনীতি / বাণিজ্য / রিজার্ভ চুরির দুই বছরেও ফেরত আসেনি সাড়ে ছয় কোটি ডলার: কাউকেই শাস্তি দেওয়া হয়নি!
রিজার্ভ চুরির দুই বছরেও ফেরত আসেনি সাড়ে ছয় কোটি ডলার: কাউকেই শাস্তি দেওয়া হয়নি!
নতুন বার্তা, ঢাকা:
|
ঠিক দুই বছর আগে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নিয়ে যায় হ্যাকাররা। এরমধ্যে এখনপর্যন্ত ফেরত এসেছে ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার। বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার ফেরত পাওয়া যায়নি। বিশ্বব্যাপী আলোচিত এই ঘটনার জন্য তৎকালীন গভর্নর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করলেও বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তাকেই এখন পর্যন্ত শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। যদিও এর জন্য দায়ী করা হয়েছে ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনকে (আরসিবিসি)। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরি করে নেয় দুর্বৃত্তরা। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কা এবং ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে। এই ঘটনার প্রায় একমাস পর ফিলিপাইনের একটি পত্রিকার সংবাদের মাধ্যমে বিষয়টি বাংলাদেশ জানতে পারে। এ ঘটনা চেপে রাখতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন ড. আতিউর রহমান। বড় ধরনের রদবদল করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শীর্ষপর্যায়ে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা মানি লন্ডারিং আইনে ১০১ মিলিয়ন ডলার চুরির অভিযোগ এনে ১৫ মার্চ (২০১৬) মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয় সিআইডিকে। তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর সিআইডি এ পর্যন্ত ২০ বার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালতের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, ‘চুরি যাওয়া রিজার্ভের অর্থ ফেরত আনতে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে। তবে মামলাটি কবে হবে, তা তিনি নিশ্চিত করেননি। তার মতে, ফিলিপাইনের আদালতও রিজাল ব্যাংককে দায়ী করেছেন। কিছু টাকা প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশকে ফেরতও দিয়েছে। কিন্তু বাকি টাকা দিতে গড়িমসি করছে। ফলে টাকা ফেরত আনতে ব্যাংকটির বিরুদ্ধে মামলা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’ এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকার গঠিত ফরাস উদ্দিনের তদন্ত রিপোর্ট এখনও প্রকাশ করা হয়নি। একইভাবে রিজার্ভ চুরির ঘটনা নিয়ে রিজাল ব্যাংকের ওপর করা তদন্ত রিপোর্টও প্রকাশ করেনি ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিএসপি (ব্যাংককো সেন্ট্রাল এনজি ফিলিপাইনস)। ফলে বিশ্বব্যাপী আলোচিত এই ঘটনার ভেতরের অনেক তথ্যই প্রকাশিত হচ্ছে না। অর্থ উদ্ধারের সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনায় রিজাল ব্যাংকের ওপর তদন্ত করেছে ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ওই তদন্ত রিপোর্টটি চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু রিপোর্টটি তারা দেয়নি।’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘ফরাস উদ্দিনের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না হওয়ার কারণে তারাও রিপোর্টটি প্রকাশ করছে না।’ এদিকে ফরাস উদ্দিনের তদন্ত রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ না হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তাকেই এর জন্য দায়ী করা যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। ২৯ জানুয়ারি মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে তিনি বলেন, ‘রিজার্ভ চুরির ঘটনায় কোনও কর্মকর্তাকে এর জন্য কোনও ধরনের শাস্তির আওতায় আনা হয়নি।’ মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে ফজলে কবির বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এক কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার ফেরত এসেছে। আরও ১২ লাখ ডলার ফেরত আসার চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এর বাইরে আরও ৫ কোটি ডলার ফেরত আসার বিষয়ে আদালতের বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এছাড়া আরও ৬০ লাখ ডলার আসার ক্ষেত্রে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এই ৬০ লাখ ডলার আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সিআইডির একটি দল ২৯ জানুয়ারি ফিলিপাইনে গেছে।’ জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে সাইবার হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পাচার হওয়া ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের মধ্যে ৪৬ লাখ ৩ হাজার মার্কিন ডলার এবং ৪৮ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার ফিলিপিনো পেসো (মোট ১ কোটি ৪৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার) ফিলিপাইন আদালতের আদেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে ২০১৬ সালের ১০ নভেম্বর ফেরত দিয়েছে। প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে সুইফটের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রায় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। এর মধ্যে ২ কোটি ডলার চলে যায় শ্রীলঙ্কায়। আর বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায় ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের চারটি অ্যাকাউন্টে। সেখান থেকে এই অর্থ একটি মানিচেঞ্জার কোম্পানি হয়ে ফিলিপাইনের তিনটি ক্যাসিনোতে চলে যায়। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তি সেই অর্থ তুলে নেয়। ঘটনার একমাস পর বিষয়টি ফিলিফাইনের একটি পত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানতে পারে বাংলাদেশ। ওই সময় বিষয়টি চেপে রাখতে গিয়ে সমালোচনার মুখে পড়ে গভর্নরের পদ ছাড়তে বাধ্য হন ড. আতিউর রহমান। রিজার্ভ চুরির বিষয়ে সম্প্রতি ড. আতিউর রহমান বলেন, ‘সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে আগে থেকে জানা না থাকার কারণে রিজার্ভ চুরির মতো ঘটনা ঘটেছিল।’ তিনি বলেন, ‘যদি এই বিষয়ে আমাদের কোনও ধারণা থাকতো, তাহলে হয়তো ওই ঘটনা ঘটতো না।’ রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে দুর্যোগের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘যেকোনও দুর্যোগ আমাদের জন্য শিক্ষণীয়। তাই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরিকে শিক্ষণীয় মনে করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’ আর যেসব কারণে ওই সময় রিজার্ভ চুরি ঠেকানো যায়নি, সেসব কারণ যেন আর না ঘটে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও সর্তক থাকার পরামর্শ দেন তিনি। |