/ সারাদেশ / নিতিশের নেশাভরা যুদ্ধক্ষেত্র ও যুদ্ধে যাওয়ার যুদ্ধ!
নিতিশের নেশাভরা যুদ্ধক্ষেত্র ও যুদ্ধে যাওয়ার যুদ্ধ!
পিকলু চক্রবর্তী:
|
১৯৭১ সালের পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন হয় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়। লাখ লাখ মানুষের উৎসর্গিত জীবন, মা-বোনের লুণ্ঠিত ইজ্জত ও শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এ স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালে নীরহ বাঙ্গালীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাষন্ড পাকহানাদার বাহিনী ,শুরু হয় রক্তক্ষরনের যুদ্ধ।এই যুদ্ধ চলে দীর্ঘ নয়মাস। এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন দেশের সর্বস্তরের মানুষ। তেমনই একজন ছিলেন দশম শ্রেণীর ছাত্র নিতিশ চন্দ্র নাগ। অবুঝ সেই কিশোর সেদিন বুঝে ওঠতে দেরী করেনি, এ আমার দেশ, এই মাটিতে আমার জন্ম। এই ভূখন্ডকে বাঁচাতেই হবে। তাই-তো বই খাতা ছুঁড়ে সেদিন হাতে নিয়েছিলেন অস্ত্র। নিতিশ মৌলভীবাজার সদরের প্রেম নগর চা-বাগান নিবাসী মৃত নরেশ চন্দ্র নাগের ছেলে। জীবণের সবচেয়ে করুন কাল আজ উনার কাছে স্মৃতি। ছোট এক ছেলে। যোদ্ধা হিসেবে তাকে কেউ গণ্য করতে চায়নি। তিনি আজ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তা কিভাবে সম্ভব ছিল? স্বাধীনতার ৪৬ বছরের বিজয়ের মাসে তিনি আপ্লুত স্বরে বর্ণনা করেছেন সেই সময়কার ঘটনাবলী। মৌলভীবাজার ঘেরা করে রেখেছে আজিজ ভাই, শওকত ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে। তখনই আমার মনের ভিতর একটা স্পিড কাজ করল ওদের সাথে মোকাবেলা করতে আমিও যাব। তারপর ইন্ডিয়া কৈলাশর গেলাম সেখানে আমার বাড়ি আছে, জমি আছে সবকিছু আছে। কৈলাশর আর,কে কলেজে সেখানে গিয়ে সব ধরণের তদন্ত শেষ করে শরনার্থীদের তালিকা ভুক্ত হলাম। মনের ভিতর শুধু একটা প্রশ্ন কাজ করছে, এখানে আমার সবকিছু আছে তবুও আমি শরনার্থী (ওয়াট ডিড ফর দ্যা কান্ট্রি) এই দেশে আমার কিছু নাই আমি যে দিকে যাবো সেখানেই আমি একজন শরনার্থী আমার স্বাধীনতা ব্যক্তিস্বত্তা কিছুই নেই! তারপর কুয়াকাটা ক্যাম্পে গেলাম সেখানে দেখলাম প্রচুর শরনার্থী বাংলাদেশ থেকে আসছেন। এই সব দৃশ্য দেখে মাথায় শুধু একটাই চিন্তা ঘুরপাক খেত কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া যায়। তবে সিদ্ধান্ত আমি পাক্কা করে রেখেছি যুদ্ধে আমি যাবই, এভাবে জীবন-যাপন করা আমার পক্ষে সম্ভব না। মনে মনে আজিজ ভাই, শওকত ভাই, সন্তোষ মামা, তাদের খুজে বেড়াচ্ছি কিন্তু পাচ্ছি না, আজিজ ভাইর বাসায় গিয়ে দেখি তিনি বাসায় নেই কোথায় বেরিয়েছেন কেউ বলতে পারে না। তারপর সন্তোষ মামাকে পেলাম তিনি সাংবাদিকতা করতেন। মামাকে বললাম আমি মুক্তিযুদ্ধে যাব। মামা জিঙ্গাসা করলেন দিদি (মাকে) বলে আসছি কি না। বললাম হ্যাঁ বলে এসেছি। আবারও বলছেন সত্যিতো বলে এসেছ? তখন আমি বললাম যা বলছি তাই বিশ্বাস করা না করা তোমার ব্যাপার তবে আমি যুদ্ধে যাবই। তিনি বললেন আমি পারব না, মুক্তিযোদ্ধারা নাকি চিড়া-পানি খেয়ে থাকছে। তখন বললাম ওরা যদি পারে আমিও পারব, আমি কি খেয়ে বাঁচব সেটা সময় বলে দিবে আপাতত যুদ্ধে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দাও । তখন সন্তোষ মামা বললেন তা হলে তুমি আজিজ ভাইর সাথে দেখা করো। রাতে আজিজ ভাইর বাসায় গেলাম দেখা হলো উনাকে বললাম আজিজ ভাই আপনি কি নেতা হলেন? ওরা আমাকে যুদ্ধে যেতে দিচ্ছে না কেন? তখন তিনি বললেন কে তোমাকে যুদ্ধে যেতে দেয় না, মনে শান্তি পেলাম আমি যুদ্ধে যাবো। এর মধ্যে আজিজ ভাইও জিজ্ঞেস করলেন মাসিমা (মাকে) বলে এসেছো'তো? হুম ভাই বলে এসেছি। পরের দিন ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে গেলেন। সেখানকার দায়িত্বরতদের থেকে বলা হচ্ছে কিছুদিন পর আমি যুদ্ধে যাব। তখন আমি বললাম না আমি যুদ্ধে যাবো বলে বেরিয়ে এসেছি, আপনাদের সাথে আমাকে এখনই যুক্ত করুন। এই বলে চলে আসলাম। গেলাম সন্তোষ মামার বাসায়। মামার বাসার সবাই বুঝতে বাকি রইল না আমি যে যুদ্ধে যাব। মামার বাসার সবাই আমাকে জিঙ্গেস করলেন মাকে বলে এসেছি কি না, একই প্রশ্ন বারবার! বললাম যুদ্ধে যাবো বললেই কি আর না বললেই কি, এই দেশটাইতো আমার মা। যে মা জন্ম দিছে, তার কাছে যাবো নাকি যে মা ডাকছে তার কাছে যাবো? দেশ বাঁচলে মা বাঁচবে, দেশ মরলে মাও মরবে, আমিও মরব। সুতরাং আমাকে যুদ্ধে যেতেই হবে। তারপর শওকত ভাই এলেন বললেন ট্রেনিং সেন্টারে আলাপ হয়েছে ৩ দিন পর প্রশিক্ষণের জন্য ডাকা হবে। শওকত ভাই এই ৩ দিনই আমাকে দেখতে এসেছিলেন, কারণ উনারা বুঝতে পেরেছিলেন আমার মাথায় শুধু এখন একটাই নেশা যুদ্ধে যাওয়ার নেশা। কখন যদি পালিয়ে যাই, অন্যকারো সাথে যুক্ত হয়ে যাই। এর মধ্যে ৩ দিনের কথা শুনে সত্যি সত্যি আমার খুব ভয় কাজ করত, কখন যদি পরিবারের কেউ জেনে যায় আমি সন্তোষ মামার বাসায় আছি?। তা হলে আর যুদ্ধে যাওয়া হবে না আমার। অবশেষে ভয়ের গন্ডি পেরিয়ে ৩ দিন পর রওয়ানা হলাম কৈলাশর ডাকবাংলায়। সেখানে আমরা ৭২ জন মুক্তিযোদ্ধা উপস্থিত ছিলাম তারমধ্যে ৫২ জন ঠিকতে পারলাম যুদ্ধের জন্য। সেখানে বাচ্চু নামে একজন বলল আমি নাকি একমাত্র কম শিক্ষিত কারণ আমি দশম শ্রেণীর ছাত্র। বাকি সবাই বিভিন্ন কলেজ ভার্সিটির ছাত্র ছিলেন। বাচ্চু তখন আরো বলে তোমরা হারাম খুর হারাম খাতায়ে তখন আমরা সবাই রেগে গেলাম বললাম আমরা হারামখুর নেহি আমরা হারাম খাতা নেহি, বলে আমরা বাংলাদেশ চলে যাবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন বাচ্চু বলল আরে কিয়া করতাহে বইটে বইটে। তারপর আজিজ ভাই,শওকত ভাই, রাজনগরের মানিক মিয়া তারা আমাদের বুঝালেন। তারপর আর্মির গাড়িতে তুলা হল সবাইকে ধর্মনগর নিয়ে গেল। সেখান থেকে আর্মিরা ট্রেনে করে করিমগঞ্জ এসে পৌঁছালাম তারপর সেখানে পাহাড়ি পথে প্রায় ৪০ কিলোমিটার জায়গা অতিক্রম করে শিলচর আসলাম। সেখানে আমাদেরকে ভূষি মিশ্রীত রুটি দেওয়া হয়েছিল খাবারের জন্য, সবাই খাওয়া দাওয়া করলাম। চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়, এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যাওয়ার জন্য বাঁশ দিয়ে সাঁকো বানানো হয়েছে, অনেক উচু নিচু পাহাড়। অনেকেই বলছেন এগুলো সাঁকো পাড় হতে গেলে তো পড়ে মরে যাব। তখন আমি বললাম আরে আমাদের মরনকে সঙ্গী করে সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো রাস্তা নেই। অবশেষে কৈলাশর থেকে শুরু হলো আমাদের অপারেশন । তবে আমার একটা সৌভাগ্য ছিল আমিতো তখন মাত্র দশম শ্রেণীর ছাত্র তাই অনেকেই মায়া করতেন। তারপর দেখা হলো পূর্বাঞ্চলের প্রধান ক্যাপ্টেন কৃষ্ণ কান্ত রাও এর সাথে। তিনি বলছেন কোথায় যাবে তুমি? আমি বললাম সিলেট জামালপুর ‘ক্যাপটেন সাদির কাছে’। তখন তিনি বলেন তুমি ছোট কিশোর পারবেনা। আমি বললাম আমি পারব। তারপর তিনি বললেন তুমি আমাদের এই ক্যাম্পে থাকো। এখানে থেকে কি করব বললেন তুমি আমাদের অফিসে থাকো, ইনফরমেশন কালেক্ট করো আর টাইপ করো। তখন বললাম আমি এখানে থাকবো না আমি বাংলাদেশে যাব। আমাকে রাখার জন্য নানা রকম প্রন্থা অবলম্বন করেন তিনি। শেষে তিনি বললেন তোমার মা বাবাকে খবর দাও এখানে আসার জন্য তুমি আমাদের এখানে থেকে কাজ করবে এবং লেখাপড়া করবে।তখন বললাম এসেছি বাংলাদেশ থেকে, যাবোও বাংলাদেশে। আমি এসেছি যুদ্ধে যাওয়ার ট্রেনিং নিতে। তবুও কোনো ভাবে তিনি রাজি হচ্ছেন না আমার কথায়। শেষে বললাম দেখেন আমি মনস্থির করে বাড়ি থেকে এসেছি যুদ্ধে যাব বলে, এখন যত বাঁধাই আসুক আমি যুদ্ধে যাবই! প্রয়োজনে আপনার সহযোগিতা ছাড়াই আমি এগিয়ে যাব। তারপর পেলাম ইন্ডিয়ান ক্যাপ্টেন হামিদ নামে একজনকে। তিনি আমাকে একটা চিঠি দিলেন। সেখানে লিখা ‘এ বাচ্ছা ছেলেটা খুবই আত্ননির্ভরশীল ও সাহসী তাকে যুদ্ধে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হউক’। ক্যাপটেনের সাথে দেখা হলো, বললাম-‘আমি নাগ’ পাশেই বসা আজিজ ভাই নাগ নাম শুনে তিনি ঘুড়ে থাকালেন দেখে বলেন ‘তুমি এইখানে’? তুমি বললে সবাইকে বলে এসেছো এদিকে তোমার বাড়ির সবাই তোমাকে খুজতেছে। তখন আজিজ ভাই বললেন তুমি আগে বাড়ি যাও, বললাম না, ক্যাপ্টেন হামিদ সাহেবও বলছেন ১ সপ্তাহের জন্য বাড়ি যাও সবার সাথে দেখা করে এসো, তারপর যুদ্ধে যাবে। বললাম না আমি এখন যুদ্ধে যাবো। আমার মা মামি ভাই বোন কেউ নেই এখন। আমার ঠিকানা এখন একটাই যুদ্ধক্ষেত্র। এতঃপর হাতিয়ার পেলাম। যুদ্ধকালীন সময় আমি তিনবার আহত হয়েছি। তারপর থেকে তো টানা নয় মাসের ভয়ংকর দৃশ্যগুলো রয়েছে যা আমাদের নতুন প্রজন্ম আজকাল অনেকটাই জানে না। নেশাভরা যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার সেই অস্বীকৃত যুদ্ধের বর্ণনা শেষে নিতিশ চন্দ্র নাগ এই প্রতিবেদকে বলেন, সর্বপরি সকল মরমী ও জিবিত সূর্য সন্তানদের প্রতি রইল আমার লাল সালাম। ও নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে বলেন আমারা-তো বাঙ্গালী, আমরা উদার মনের জাতি, সকলেই ভালবাসার কাঙ্গালী। তাই আমি মনে করি দেশ ও দেশের মানুষকে ভালবাসার সহজ উপায় হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। |