/ আন্তর্জাতিক / ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ থেকে সৌদির ফিরে আসার পথ রুদ্ধ: বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের নতুন সমীকরণ
ইয়েমেন গৃহযুদ্ধ থেকে সৌদির ফিরে আসার পথ রুদ্ধ: বিভক্তি ও দ্বন্দ্বের নতুন সমীকরণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
|
মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ পরিস্থিতি নতুন মোড় নিল। বিশেষ করে সৌদি জোটের আগ্রাসন বিস্তারের আরও সুযোগ করে দিল ইয়েমেনের হুথিরা। হুথিদের সঙ্গে মিত্রতা ছাড়ার ঘোষণার অল্প কয়েক ঘণ্টা পরেই নিহত হন ইয়েমেনর সাবেক প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। সোমবার (৪ ডিসেম্বর) সকালের দিকে সানায় আলী আব্দুল্লাহ সালেহের বাসভবনে হামলা করে হুথিরা। ইয়েমেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদিকে গদিচ্যুত করতে এই হুথিদের সাহায্য নিয়েছিলেন আলী আব্দুল্লাহ সালেহ। ইরানের মদদপুষ্ট শিয়া বিদ্রোহীদের সাহায্যে মনসুর হাদির আসন কাঁপিয়েও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, সেই মিত্র হুথি বিদ্রোহীদের হাতেই প্রাণ হারালেন সালেহ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সালেহের হত্যায় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সৌদি-নেতৃত্বাধীন জোটের লড়াই আরও বেশি তীব্রতর হয়ে ওঠবে।’ ইয়েমেন পোস্টের প্রধান সম্পাদক হাকিম আল মাসমারী বলেন, ‘হুথি যোদ্ধাদের হাতে তাদেরই এক সময়কার মিত্র সালেহের মৃত্যু তার বাহিনীর জন্য বড় ধরণের আঘাত।’ ইয়েমেনের রাজধানী সানা থেকে আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘গত দুই দিন ধরে তাঁর বাড়ি অবরুদ্ধ করে রাখে হুথিরা এবং আজ তাতে হামলা চালায় তারা। তিনি (সালেহে) পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু হুথিদের চেকপয়েন্টে এক সংঘর্ষে তিনি নিহত হন। সেখানে একটা গাড়িতে তার লাশ পাওয়া গেছে। তার সাথে নিহত হন তার কয়েকজন প্রধান সহকর্মীও।’ তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ইয়েমেন শাসন করেছেন সালেহে। বর্তমান গৃহযুদ্ধ পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক সংকটে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ছিল তার। ইয়েমেনের ওপর হামলা চালানোর জন্য শনিবার এক টেলিভিশন বক্তৃতায় সৌদি জোটকে আহবান করেছিলেন তিনি। একই সাথে সালেহ হুথি বিদ্রোহীদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। তিনি সামরিক জোটের সাথে সংলাপের জন্য আহবান করেন, যারা দুই বছর ধরে বিদ্রোহী জোটের সাথে যুদ্ধ করছিল। সালেহের এ ঘোষণায় সৌদি আরব প্রশংসা করলেও হুথিরা তার এ পক্ষাবলম্বনকে বড় ধরণের 'আঘাত' হিসেবে দেখে। ২০১৫ সালে হাদিকে হুথিরা ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। সে বছরই সৌদি আরব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য সুন্নি মুসলিম দেশ মিলে ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আবদ-রব্বু মনসুর হাদি সরকারকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দেশটিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে। তাদের পক্ষে আছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল সমর্থন। এ বছরই সৌদি আরব সফর গিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সৌদি জোটের পাশে থাকার ঘোষণা দেন। সেসময় সালেহের দুর্বল জোটের সাথে হুথিরা যুক্ত হলে শক্তিশালী অবস্থানে চলে যান তিনি। তার জেনারেল পিপলস কংগ্রেস পার্টি(জিপিসি) এবং হুথি আনসারাল্লাহ জোটের মধ্যে সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ সৃষ্টি হয়। যদিও এক সময় এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিরোধী ছিল। মাসমারি বলছেন, ‘সালেহের মৃত্যু দেশটিতে সৌদি জোটের হামলা আরও জোরদার হবে। দুই পক্ষের মধ্য বিভক্তিতে সৌদি জোট হুথি নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আরও বেশি বিমান হামলা চালাবে। বিশেষ করে বিমানবন্দর ও সরকারি মন্ত্রণালয়গুলোকে লক্ষ্যবস্তু বানাবে।’ ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মধ্যপ্রাচ্যের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর জোওস্ট হিলটারমান বলেন, ‘হুথি ও সালেহ জোটের এ বিভক্তি প্রতিশোধের পর্যায় থেকে আরও বেশি বিভক্তি ও দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে তুলবে। সালেহের বাহিনী যে কোন মুহুর্তে হুথি বিরোধী দলের সাথে যোগ দিতে পারে।’ তিনি বলেন, ‘সালেহের ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি যে উন্নতির দিকে যাচ্ছিল বিশেষ করে সৌদি জোটের পক্ষে, যাতে আরব আমিরাতের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তারা আশা করেছিল, সালেহের মাধ্যমে হুথিদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারা যাবে। কিন্তু ঘটনা মোড় নিয়ে গেছে ভিন্ন দিকে। এর মাধ্যমে হুথিদের সামরিক শক্তিকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার পথ বের হয়ে আসল মূলত।’ হিলটারমানের মতে, ‘যদি তারা আকাশপথে হামলা দ্বিগুণ করে তাহলে দেশটির বেসামরিক জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি। ইতিমধ্যে সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে সেখানে।’ যুদ্ধ শুরু হবার পর থেকে এ বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত দেখা গেছে, সেখানে ৮০ শতাংশ ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। তাদের বেঁচে থাকার জন্য সামান্য অবলম্বনটুকুও অবশিষ্ট নেই। যদিও আন্তর্জাতিক চাপে সাম্প্রতিক দেশটির বন্দর খুলে দিয়েছে সৌদি জোট। সৌদি জোটের হামলায় সেখানের চিকিৎসা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধসে গেছে। সাম্প্রতিক বিশ্বের সবচেয়ে বড় কলেরা মহামারি ছড়িয়ে পড়েছে দেশটিতে। ইতিমধ্যে কয়েক লাখ লোক কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে কয়েক হাজার। লন্ডন কিংস কলেজের রাজনৈতিক বিশ্লেষক এন্ড্রিজ ক্রেইগ বলেন, ‘খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্বের পরিস্থিতির চেয়েও আরও বেশি ব্যর্থ রাষ্ট্রের দিকে চলে যাবে ইয়েমেন।’ এ বছরের শুরুতে ফাঁস হওয়া কিছু ইমেল বার্তায় দেখা যায়, প্রাক্তন এক মার্কিন কর্মকর্তার সাথে কথা বলার সময় সৌদি আরব ইয়েমেন যুদ্ধের ইতি টানার ইচ্ছা প্রকাশ করে। তিনি বলেন, ‘সালেহ ছিলেন যোগ্য সমন্বয়ক। তাকে হত্যা করে হুথি বিদ্রোহীরা সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘সৌদি আরব চাচ্ছিল 'ব্যয়বহুল' এ যুদ্ধের ইতি টানতে। কিন্তু এখন যুদ্ধ থেকে তাদের ফিরে আসার কোন পথ নাই।’ (কাতার ভিত্তিক আল জাজিরার প্রতিবেদন অবলম্বনে) |